এই প্রথম লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হলো: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

গতকাল সকালে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ চার্জ গঠন শুনানি হয়।

এই প্রথম লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হলো: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

প্রথম নিউজ, অনলাইন: অর্থ আত্মসাতের দুদকের মামলায় এজলাস কক্ষে আসামিদের জন্য স্থাপিত লোহার খাঁচায় দাঁড়িয়ে শুনানি কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটিকে ড. ইউনূস তার জীবনের প্রথম ও স্মরণীয় ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। গতকাল সকালে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ চার্জ গঠন শুনানি হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইউনূসসহ মামলার ১৪ আসামি আদালতে উপস্থিত হন। সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দুদকের অর্থ আত্মসাৎ মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় আদালত আসামিদের জন্য স্থাপিত লোহার খাঁচায় গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। তখন অন্য আসামিদের সঙ্গে লোহার খাঁচায় প্রবেশ করেন ড. ইউনূস। এ সময় ড. ইউনূসের আইনজীবীরা তাকে বলেন, আপনাকে নয়, অন্যদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলেছেন। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, অসুবিধা কি সবাই দাঁড়ালে আমিও দাঁড়াই। এরপর বেলা ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে আদালত সবাইকে এজলাস কক্ষে থাকা বেঞ্চে বসতে বলেন।

পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্য সবাইকে নিয়ে আদালতে থাকা আসনে বসেন। এ বিষয়ে ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন মানবজমিনকে বলেন, মামলার চার্জ গঠনের শুনানি শুরু হলে আসামিদের আদালত লোহার খাঁচায় প্রবেশ করতে বলেন। আদালত ড. ইউনূসকে লোহার খাঁচায় প্রবেশ করতে না বললেও অন্য সহকর্মীদের কথা বিবেচনা করে তিনিও প্রবেশ করেন। পরে আদালত সবাইকে এজলাসের বেঞ্চে বসতে বললে বের হয়ে আসেন তিনি। শুনানি শেষে ড. ইউনূস সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, এই প্রথম লোহার খাঁচায় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। এটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। এটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা যে, লোহার খাঁচার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি আদালতের কাঠগড়ায়। এ অভিশপ্ত জীবনের একটা অংশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই যে, এক নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে আরেক নোবেল বিজয়ী মামলা করেছে। গতকাল দুপুরে দুদকের করা অর্থ আত্মসাতের মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষে ড. ইউনূস সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতে হাজির হয়ে ড. ইউনূস মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি শুরু করেন। পরে ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন মামলা থেকে ড. ইউনূসের অব্যাহতি চেয়ে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। শুনানি শেষ হলেও আদালত বিচার শুরু বা আসামিদের অব্যাহতি দেয়ার বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি। আদেশের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন আগামী ১২ই জুন দিন ধার্য করেন। 

আদালত প্রাঙ্গণে ড. ইউনূস বলেন, দেশের নাগরিক হিসেবে বলতে চাই, কেন কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হবে? আমার সহকর্মীরা তাদের জীবন দিয়ে দিয়েছে মানুষের উপকারের জন্য, তাদের কেন হেনস্তা করতে হবে। তাদেরকে লোহার খাঁচায় কেন ঢুকতে হবে।  আমরা নোবেল পুরস্কারের কথা সবাই জানি। দুটো নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। একটা আমার নামে, আরেকটা গ্রামীণ ব্যাংকের নামে। দুটোই সম্মান-মর্যাদার। এটা যৌথভাবে দেয়া হয়েছে তাও না, দুটোই ইনডিপেনডেন্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো নজির নাই যে, এক নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে আরেক নোবেল বিজয়ী মামলা করেছে, দুদকে হাজির হয়েছে। এটা আমাদের কপালে হয়েছে, এটা অভিশাপের একটা অংশ। এই অভিশাপ আমরা বহন করে যাচ্ছি। বিষয়টা এমন হয়েছে যে, পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মতো দুই নোবেল বিজয়ী, আমার কারণে যেটা সৃষ্টি হয়েছে, নোবেল পুরস্কার পেয়েছে সেটাও আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে, কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে এমনভাবে নিয়ে আসলো, খুব কঠিন ভাষায়, রূঢ় ভাষায় আক্রমণ করলো। তিনি আরও বলেন, অভিযোগ থাকতে পারে, কিন্তু রূঢ় ভাষায় আক্রমণ করে অভিযোগ করলো, যে অভিযোগের ভিত্তি নেই। ঘটনার মধ্যে কোনো সত্যতা তো নেই, যে জিনিস দিয়ে দিয়েছিলাম, সেটার জন্যই আমাকে অভিযুক্ত করা হলো যে, অনেক টাকা মেরে দিয়েছি ইত্যাদি।

ড. ইউনূস বলেন, এ পর্যন্ত যত অভিযোগ এসেছে আমার বিরুদ্ধে এবং আমার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে, এটা আমার মনে কঠিনভাবে দাগ কেটেছে, কষ্ট লেগেছে কারণ আমার পরিবারকে আক্রমণ করেছে। বহুদিন গেছে আমাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হয়েছে। কোনো নিস্তার নেই, একটার পর একটা চলছে। অভিশপ্ত জীবনের একটা বড় পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। অভিশাপ বয়ে বেড়ানো প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, এটা দেব-দেবীর ইচ্ছা। এখানে আমার কিছু করার নেই। দেব-দেবীরা ঠিক করেন যে, একে অভিশাপ দিতে হবে, অভিশাপ দিয়েছে আমাকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতে হবে। 

আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না যে, বেনজীর পালিয়ে গেছেন কিনা। পি কে হালদার বের হয়ে গেল টাকাসহ। এস আলম গ্রুপের লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে দেয়া হলো। বেনজীর, আজিজ, পি কে হালদার, এস আলম এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ড. ইউনূসকে ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করে অপমান করা হচ্ছে। চোর-বাটপাররা কোটি কোটি টাকা নিয়ে চলে যাবে বাইরে, আর যারা দেশপ্রেমিক তারা যাবে কারাগারে এই হচ্ছে অবস্থা। তিনি বলেন, অভিযোগ আনতে হলে সুনির্দিষ্ট টাকার পরিমাণ বলতে হয়। দুদক একবার বলছে ২৬ কোটি, আবার বলছে ২৫ কোটি। দুদক ১ কোটি টাকা আইনজীবীর ফি নির্ধারণ করে বলেন, ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দুদক আইনজীবীর ফি নির্ধারণ করার কে? তিনি আরও বলেন, এই সরকারের আমলে যতবার বাংলা একাডেমির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে দেশের বাইরের নোবেল বিজয়ীদের দাওয়াত করা হয়েছে। কিন্তু দেশের নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। অথচ দেশের বাইরের লোকজন তাকে গেস্ট ও লেকচারার হিসেবে পেতে উদ্‌গ্রীব থাকেন। অথচ নিজ দেশে এমন একজন নোবেল জয়ীর মূল্যায়ন নেই।   

গত ১লা ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা এই মামলায় ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক। ড. ইউনূস ছাড়া অভিযোগপত্রে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম এবং এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম এবং জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের দপ্তর সম্পাদক মো. কামরুল হাসানকে আসামি করা হয়। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে কামরুল হাসানের নাম তদন্তের পর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অপর ব্যক্তিদের নাম এজাহারে ছিল। দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে গত বছরের ৩০শে মে মামলাটি করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিরা ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে, যা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।