‘এই জমি না দিলে বিষ দেন, খেয়ে মরি’
সোমবার বিনা নোটিশে প্রশাসনের কর্মকর্তারা তিনটি ঘর পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেন।
প্রথম নিউজ, কুষ্টিয়া: টিনশেডের ভাঙা ঘরগুলোর নানা অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মাটিতে। বাসিন্দাদের কেউ ত্রিপল টানিয়ে আছেন; কেউ আশ্রয় নিয়েছেন পাশের রাইস মিলের বারান্দায়; কেউ ভাঙা বেড়ার ঘরেই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এ দৃশ্য কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সদকী ইউনিয়নের বাটিকামারায়।
সোমবার বিনা নোটিশে প্রশাসনের কর্মকর্তারা তিনটি ঘর পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেন। বাকি দুটির চালা ছাড়া বাকি সব খুলে ফেলা হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতার ধাওয়ায় পালিয়ে যান কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদিত্য পাল।
ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে ওই পরিবারের সদস্যদের দুর্ভোগ দেখা যায়। এ সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে স্বজন ও প্রতিবেশীদের। স্থানীয় কিছু উৎসুক জনতাও সেখানে ভিড় করেন। এ সময় বিলাপ করতে করতে দিনমজুর আবু
ওই পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার তরুণ মোড়-তারাপুর সড়কের বাটিকামারা এলাকায় সরকারের এক নম্বর খতিয়ানভুক্ত ১০ শতাংশ খাস জমি আছে। এর ৫ শতাংশ জমিতে প্রায় ৩০ বছর আগে ওই গ্রামের দিনমজুর ইসমাইল শেখ থাকতে শুরু করেন। প্রায় পাঁচ বছর পর বাকি ৫ শতাংশে বসবাস শুরু করেন মৃত আছাম উদ্দিনের স্ত্রী বুলু খাতুন। ওই নারী আওয়ামী লীগের এক সাবেক সংসদ সদস্যের বাড়িতে কাজ করতেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ১০ শতাংশ জমিই নিজের নামে স্থায়ী বন্দোবস্ত করেন বুলু খাতুন। ২০০২ সালে সেখান থেকে ২৫ হাজার টাকায় ৫ শতাংশ জমি কিনে নেন ইসমাইল শেখ। সেখানে ইসমাইলের স্ত্রী আমিরন নেছা ও তাদের পাঁচ সন্তান সাজু শেখ, রাজু শেখ, সাইদ শেখ, লালন শেখ ও কুতুব উদ্দিন বসবাস করছেন। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া আদালতে বুলু খাতুনকে দিয়ে ৫ শতাংশ জমি থেকে ওই পরিবারটিকে উচ্ছেদের জন্য মামলা করান তাঁর নাতি রাজিব হোসেন। আদালত গত ২৭ অক্টোবর পাঁচ ভাইকে জমি থেকে উচ্ছেদের আদেশ দেন। তাদের উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো নোটিশ না দিয়েই প্রশাসন সোমবার অভিযান চালায়।
ইসমাইলের স্ত্রী আমিরন নেছা বলেন, ‘রাজিব ক্ষমতা খাটিয়ে ও ব্যাটাদের (প্রশাসনের কর্মকর্তা) ঘুষ দিয়ে ঘরবাড়ি সব ভেঙে দিছে। গতকালকের (সোমবার) তে খাওয়া দাওয়া বন্ধ। এহন নাতি, পুতি, ব্যাটা, ব্যাটার বউ নিয়ে রাইস মিলের বারান্দায় আছি। যাওয়ার কোনো জাগা নেই। তাঁবু টানা হলিও যেম্বায় (যেভাবেই) হোক, হেনেই থাকব।’
তাঁর ছেলে কুতুব উদ্দিন বলেন, জনগণের ভয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তারা ইউএনও অফিসে যান। ইউএনও তাদের বিষয়টি লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন। রাজু শেখের স্ত্রী জাহিরন খাতুন বলেন, ‘শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি আমরা।’ থাকার একটি ব্যবস্থা করতে সংবাদকর্মীদের প্রতি আকুতি জানান তিনি। বাটিকামারার প্রবীণ ব্যক্তি আনছার উদ্দিন এসেছিলেন তাদের দুর্ভোগ দেখতে। তিনি বলেন, ‘শুনলাম গরিব মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙে দেছে। তারা না খেয়ে আছে। সেজন্য কয়ডা খাবার নিয়ে দেখতে এসেছি।’
উচ্ছেদের পর সোমবার বিকেলেই বিক্ষুব্ধ জনতা বুলু খাতুনের নাতি রাজিবের ঘরবাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। পরে কয়েকশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ ভাইকে নিয়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। মঙ্গলবার রাজিব হোসেনের আধাপাকা বাড়ি ও আসবাবে ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা যায়। ভাঙা অংশগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ঘটনার পর থেকেই রাজিব সপরিবারে পালিয়ে যান। এ জন্য তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোলায়মান শেখ বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলামের ভাষ্য, আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসন বাটিকামারায় অভিযান চালিয়েছিলেন। ভুক্তভোগীদের বিষয়টি আদালত ও প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। লিখিত পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।