অসময়ে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা: জলবায়ুর সঙ্গে দায়ী নগরবাসীও
বিগত সকল রেকর্ড ভেঙে এবার নিরাপদ সময়েও ভয়াবহ বিস্তার শুরু করেছে মশাবাহিত এই রোগ। শুধু ১৯ মে থেকে গত ৫ দিনেই ডেঙ্গু রোগে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২০৬ জন রোগী।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে ডেঙ্গুর গতিপ্রকৃতিতে। বিগত সকল রেকর্ড ভেঙে এবার নিরাপদ সময়েও ভয়াবহ বিস্তার শুরু করেছে মশাবাহিত এই রোগ। শুধু ১৯ মে থেকে গত ৫ দিনেই ডেঙ্গু রোগে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২০৬ জন রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া গত ৩ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২২৭ জন আক্রান্তের মধ্যদিয়ে দেশে ২০২১ সালের ডেঙ্গুর মূল আঘাত শুরু হয় জুন মাসে। সে বছরের জানুয়ারিতে ১৩, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চে ১৩, এপ্রিলে ৩ এবং মে মাসে ৪৩ জন আক্রান্ত হয়। পরের বছরের মে মাসে ১৬৩ জন আক্রান্তের মাধ্যমে ডেঙ্গুর নতুন প্রভাব শুরু হয়। জুনে আক্রান্ত হয় ৭৩৭ জন। এরপর আর নামেনি ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান।
বিগত বছরগুলোতে শীতের সময়কে নিরাপদ ধরা হতো। ২০২১ সালে তুলনামূলক কম তাপমাত্রার সময় জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আক্রান্ত ছিল মাত্র ১০০ জন, সেখানে এ বছর সব পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহেই আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৬৮ জনে। শুধু মে মাসের গত ২৪ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮২ জন। বিগত বছরগুলোতে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তেমন কোনো নজির না থাকলেও চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসেই প্রাণ গেছে ১৩ জনের। এটি বছরব্যাপী ডেঙ্গু বিস্তারের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন ডেঙ্গু রোগ নিয়ে গবেষণা করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগি অধ্যাপক ডা. শেখ ফজলে রাব্বী চৌধুরী।
তিনি বাংলাভিশনকে বলেন, সাধারণত শীতের সময় ডেঙ্গু একদমই থাকার কথা না। শুধু বাংলাদেশ না এটা বিশ্বের কোথাও থাকে না। কিন্তু এবছর বাংলাদেশে আমরা ব্যতিক্রম দেখলাম। সারা বছরই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেও রোগী ছিল শতাধিক। এটা থেকে বুঝা যাচ্ছে এই অঞ্চলে ডেঙ্গু সারাবছর থাকতে যাচ্ছে।
আগাম চলে আসায় চলতি বছর ডেঙ্গুর বিস্তার আরও ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণেরও পরামর্শ দিয়ে ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী বলেন, বুঝাই যাচ্ছে এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ হতে পারে। এজন্য প্রথমত রাষ্ট্রীয়ভাবে ভেক্টর কেন্ট্রোলকে জোরদার করতে যা করার সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে সেটা করতে হবে। আর চিকিৎসাব্যবস্থার ক্ষেত্রে ডেঙ্গু মেনেজমেন্টে আমাদের চিকিৎসকরা এখন বেশ পটু। তবে এই রোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যথাযথ ফ্লুইড মেনেজমেন্ট। এখনই চিকিৎসকরা ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় দেওয়া জাতীয় নির্দেশনাটি আবার দেখে নিজেদের প্রস্তুত করে নেওয়া প্রয়োজন। নিয়ম অনুযায়ী ফ্লুইড মেনেজমেন্ট এবং ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হলে ডেঙ্গু মোকাবিলা আরও সহজ হবে।
রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে টেস্টকিট মেনেজ করাসহ নানান সংকট তৈরি হয় জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা মাথায় নিয়ে এখনি পর্যাপ্ত টেস্টকিট মজুদ করা দরকার। আর সুযোগ পেলেই বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীদের জিম্মি করে টেস্ট করাসহ ডেঙ্গু চিকিৎসায় বাড়তি টাকা নেয়। তাই এ বিষয়ে গত বছরের মতো ফি নির্ধারণ করে এখনি কড়া নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া দরকার।
যদিও নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত বৃষ্টির দিনে ডেঙ্গু মশা জন্মের আদর্শ পরিবেশ ও তাপমাত্রা থাকায় এই সময়ে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে থাকে। কিন্তু এবার কেনো সেই নিয়ম ভেঙে বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রভাব রয়ে গেল জানতে চাইলে মশা বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ব গবেষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনে ঋতুপ্রকৃতি পাল্টে যাওয়ায় এখন বছরজুড়েই থাকছে মশা উৎপাদনের আদর্শ তাপমাত্রা। একইসঙ্গে আছে নগরবাসীর অবহেলাও।
তিনি আরও বলেন, বিগত বছরগুলোর সাথে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে জানুয়ারি থেকে মে মাসে এত রোগী কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু এবার এমন কেন হলো সেটা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায়, ঢাকার নগরায়নে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, প্রচুর উঁচু ভবন হয়েছে। অনেক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে, অনেকের গাড়ি হয়েছে সেগুলো ভবনের নিচে ধোয়ার পর সেই পানি কোথাও না কোথাও জমে থাকছে। আবার যেখানে পানির সংকট আছে সেখানে নগরবাসী পাত্রে পানি জমিয়ে রাখছে। এতে আমরা এডিসের লার্ভা পাচ্ছি। আর নির্মাণাধীন ভবনেতো বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকেই। তাছাড়া, এখন আমাদের দেশে সারাবছরই মশার বংশবিস্তারের উপযুক্ত তাপমাত্রা থাকে।
তিনি আরও বলেন, সাধারণত বর্ষাকাল শুরু হলে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে বলে সেখানে ডেঙ্গু জন্মের হার বাড়ে। তাই তখন এডিসের প্রাদুর্ভাবও বাড়ে। মে মাসে সেটাই হয়েছে। এজন্যই মাসের মধ্যভাগ থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার সাথে সাথে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেড়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগ ও নগর প্রশাসনকে আরও তৎপর হওয়ার পাশাপাশি মশা দমনে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করারও পরামর্শ দেন তারা।