আমদানি বন্ধ করলে রপ্তানিও ঝুঁকিতে পড়বে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে না পড়লেও দেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র, তাই সেদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, যারা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশ থেকে কোনোরকম কেনাকাটা করবে না বাংলাদেশ। তিনি এই বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনাও দিয়ে দিয়েছেন বলে জানান। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে কি-না এ নিয়ে চলছে আলোচনা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে না পড়লেও দেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র, তাই সেদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে কোনো দেশের নাম বলেননি। বাংলাদেশের র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার প্রতি ইঙ্গিত করেই প্রধানমন্ত্রী এই বক্তব্য দেন। অর্থনীতিবিদ ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, দেখতে হবে যে, আমরা আমদানি কমাতে পারি কিনা। আমাদের তো আমদানিতে কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, যন্ত্রপাতি এগুলো উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই আমদানি কমানোর সুযোগ কম আছে। তবে আমদানি কমালে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হবে। প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। আমরা কোনো পলিসি নিয়ে যদি আমদানি কমাই কোনো বিশেষ দেশ থেকে, তাহলে তারা আমাদের রপ্তানির ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেয় সেটি দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রপ্তানির জন্য একটি বড় বাজার। তারা রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে কিনা, সেটা নির্ভর করছে আমরা সত্যিই আমদানি কমাই কিনা। যদি আমরা সত্যিই আমদানি কমাই, তখন তারা দেখবে আমরা যদি কোনো নীতিগত পরিবর্তনের কারণে আমদানি কমাই তাহলে তারাও একটা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। তারা যদি ব্যবস্থা নেয় তাহলে আমাদের নিশ্চয়ই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা খুব বেশি আমদানি করি না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের উপর রপ্তানিতে আমরা বহুলাংশে নির্ভরশীল। আরএমজিতে আমাদের বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ভালো সম্পর্ক আছে। তারা যখন দেখবে যে কি ব্যাপার; তাদের থেকে আমরা আমদানি বন্ধ করেছি...এটা আসলে আনসারটেইনলি চলে আসে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা মেশিনারিজ, টেকনোলজির জিনিসপত্র আমদানি করে থাকি। সেদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে আমাদের জাপান, জার্মান বা তাদের সঙ্গে যেসব দেশের ভালো সম্পর্ক সে সব দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। তারা যখন দেখবে আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বন্ধ করেছি তখন তারাও চিন্তা করবে তাদের সঙ্গে আমাদের কেন আমদানির সম্পর্ক নাই। এটা হঠাৎ করে ইম্পেক্ট না পড়লেও আমার মনে হয় বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে হয়তো কৌশলে কিছু পণ্য আমদানি করবে না। প্রধানমন্ত্রী আসলে একটা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে নানা কিছু হচ্ছে। তারা স্যাংশান দিচ্ছে... এখন এটা অর্থনীতির সঙ্গে নিয়ে যাওয়া কোনো দেশের জন্য যুক্তিযুক্ত হবে না।
প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান বলেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশেরই বাণিজ্যনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি এগুলো কোনো একজন ব্যক্তির অভিমান, ক্ষোভের উপর নির্ভর করে না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন, যে যারা স্যাংশান দেয় তাদের থেকে কিছু কিনবো না- এই কথার উপর ভিত্তি করে আমি মনে করি না যে, আমেরিকার কোনো বাণিজ্যনীতি আছে- বাংলাদেশ থেকে উনারা যেটা কিনে তাতে সেটা পাল্টে যাবে। এভাবে করে একদিনে ম্যানুফ্যাকচারিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব ডিসিশন, এগুলো পরিবর্তন করা যায় না। এমনকি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি এটা নির্ধারণ করে না যে, কোন কোন জায়গা থেকে কোন কোন জিনিস কিনবে। এগুলোর ক্ষেত্রে আইন করতে হয়, তাদের পররাষ্ট্র থেকে শুরু করে সেক্রেটারিয়েট এবং অন্যরা মিলে তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে, বা মিডিয়ার সঙ্গে আলোচনা হয়।
এভাবে তারা ঠিক করে থাকে যে, আমরা এখান থেকে এটা কিনবো না। যেটা চায়নার ক্ষেত্রে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশকিছু পলিসি ঘোষণা করেছে চায়নার ক্ষেত্রে। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও তারা খুব একটা সিরিয়াসলি নেয় না। বাংলাদেশের থেকে এই আমদানিটাও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আমদানি নয়। কারণ বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে সেটা যদি ওরা ফ্রেজআউট করে সেটা তারা অন্যান্য দেশ থেকে কিনতে পারবে। বিশে^র অনেক দেশই এগুলো বিক্রি করার জন্য বসে আছে।
সিরডাপের পরিচালক অর্থনীতিবিদ মো. হেলাল উদ্দিন মনে করেন, যারা স্যাংশন দিয়েছে তাদের সঙ্গে লেনদেন না করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাজনৈতিক। কারণ আমাদের সাংশন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে লেনদেন না করে থাকা সম্ভব নয়। একক দেশ হিসেবে আমরা তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করছি যুক্তরাষ্ট্রে। ডলার সংকটে আমরা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক থেকে যে সফট লোন নিচ্ছি তার জন্যও তো যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন। কারণ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের পেছনের কলকাঠি তো যুক্তরাষ্ট্রেরই হাতে। তিনি বলেন, এটা তো মুখে বললে হবে না। সরকারের তো আদেশ জারি করতে হবে লেনদেন না করার। বেসরকারি খাত কি সরকারের মুখের কথা শুনবে? আর সেটা শোনা কি সম্ভব? তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী এইসব কথা বলে কিছুটা দরকষাকষি করতে চান। প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর করলেন। জাপান কি যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে কিছু করবে? আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক আছে কেনাকাটার সম্পর্ক থাকবে না- এটা একটা অসম্ভব চিন্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইট সেনসাস-এর তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ছিল ১১.১৭ বিলিয়ন এবং আমদানি ছিল ২.৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত সেদেশে রপ্তানি হয়েছে ২.৪০ বিলিয়ন, আর আমদানি হয়েছে ৫৯৫ বিলিয়ন। ২০২১ সালে রপ্তানি ছিল ৮.২৯৯ বিলিয়ন এবং আমদানি ছিল ২.৩৫ বিলিয়ন। ২০২০ সালে রপ্তানি ছিল ৬.০৬ আর আমদানি ছিল ৮.৮৫ বিলিয়ন। অফিস অব দ্য ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর)- এর ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম বৃহত্তম পণ্য ব্যবসায়িক অংশীদার। যেখানে ২০১৯ সালে মোট ৯.০ বিলিয়ন ডলার পণ্য বাণিজ্য হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করেছে ২.৩ বিলিয়ন। পণ্য আমদানি করে মোট ৬.৭ বিলিয়ন ডলারের। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম বৃহত্তম পণ্য রপ্তানি বাজার। ওই বছর বাংলাদেশে মার্কিন পণ্য রপ্তানি ছিল ২.৩ বিলিয়ন ডলারের। ওই বছর শীর্ষ রপ্তানি বিভাগগুলো ছিল বিমান (৬৮৮ মিলিয়ন), বিবিধ শস্য, বীজ, ফল (সয়াবিন) (৪০৩ মিলিয়ন), তুলা (৩৮৯ মিলিয়ন), লোহা ও ইস্পাত (৩২১ মিলিয়ন), এবং যন্ত্রপাতি (৭৮ মিলিয়ন)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মোট ৯৫৭ মিলিয়ন ডলারের কৃষি পণ্য রপ্তানি করে। শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি বিভাগগুলোর মধ্যে ছিল- তুলা (৩৮৮ মিলিয়ন), সয়াবিন (৩৮৮ মিলিয়ন), গম (৫২ মিলিয়ন), ডিস্টিলার শস্য (৩৫ মিলিয়ন), এবং অন্যান্য (২৫ মিলিয়ন)।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ আমদানি বিভাগগুলো ছিল- তৈরি পোশাক (৪.১ বিলিয়ন), নিট পোশাক (১.৬ বিলিয়ন), হেডগিয়ার (২০৮ মিলিয়ন), বিবিধ টেক্সটাইল পণ্য (২০২ মিলিয়ন) এবং জুতা (১৫৬ মিলিয়ন)। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে মোট ২১ মিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য আমদানি করে। শীর্ষস্থানীয় বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে: তামাক (৬ মিলিয়ন), স্ন্যাক ফুড (৪ মিলিয়ন), চাল (২ মিলিয়ন), ভেষজসহ চা (১ মিলিয়ন)।