অর্থনীতির মূল চালিকা রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় কমেছে
উচ্চ আমদানি ব্যয়, রিজার্ভ সংকট, সেইসঙ্গে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়ায় ঝুঁকি বাড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: উচ্চ আমদানি ব্যয়, রিজার্ভ সংকট, সেইসঙ্গে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়ায় ঝুঁকি বাড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় কমেছে আকস্মিকভাবে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং হোম টেক্সটাইলের রপ্তানিও অব্যাহতভাবে কমেছে। ফলে এসব খাতে সংকট আরও বাড়ছে। এতে চাপ বাড়ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। এ অবস্থায় বিশেষ করে অপচয়, অদক্ষতা ও দুর্নীতির মতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সঠিক পলিসি ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে সামনের দিনগুলো স্বস্তিদায়ক হবে না। বৈদেশিক ঋণ নিয়েও চাপ সামলানো যাবে না- যদি না পুঞ্জিভূত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা না হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয় আগের বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ইউরোপের বাজারে অর্ডার কমে গেছে। ফলে কমে গেছে রপ্তানি আয়। ইপিবি বলছে, এপ্রিলে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৫ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৩৩৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের এপ্রিলে ছিল ৩৯৩ কোটি ডলার। নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিও। ইপিবির তথ্যমতে, এপ্রিলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটি ডলারে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৫২ শতাংশ কম। এ ছাড়া কৃষিজাত পণ্যে ২৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, পাটজাত পণ্যে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অন্যদিকে ডলারের বাজারে অস্থিরতার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডি বা অবৈধ পথে পাঠানোয় কমেছে রপ্তানি আয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, একই মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ১৬ দশমিক ২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে, যা ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, সরকারের যখন বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন তখন রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলে অবশ্যই সেটি চাপ সৃষ্টি করে। সেক্ষেত্রে বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেয়া উচিত। তিনি মানবজমিনকে বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলেও দেশের অভ্যন্তরে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। কারণ গত বছর অনেক মানুষ বিদেশে গিয়েছে। ফলে দেশে অর্থ আসছে সেটা যেভাবেই আসুক। আর সামনে ঈদুল আজহা উপলক্ষে অনেক রেমিট্যান্স আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে রপ্তানি আয় উঠানামার মধ্যে থাকবে বলে আমার ধারণা। তবে এই মুুহূর্তে আমাদের রিজার্ভের যে পরিস্থিতি তাতে বৈদেশিক মুদ্রা যত আসবে ততই আমাদের জন্য ভালো। তাই সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নেয়া উচিত যে কীভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়। ব্যয় সংকচনেরও প্রয়োজন রয়েছে। রেমিট্যান্সের উপর চাপ কমানো দরকার। কারণ শুধুমাত্র আয় দিয়েই আমরা স্বাভাবিকে চলে যাবো সেটা সম্ভব নয়। সুতরাং ব্যয় কমিয়ে যতটুকু সম্ভব এই সময়টা অতিবাহিত করা যায়।
আবার সরকার যেন এমন না করে যে, যেনতেনভাবে বুঝিয়ে দেয়া। এই উদ্যোগগুলো নেয়া দরকার অপচয় কমানো ও প্রশাসনিক ব্যয়ভার কমানো, অদক্ষতা, দুর্নীতি- এগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন করেই উদ্যোগগুলো নেয়া দরকার। পলিসির ক্ষেত্রে ঠিক একইভাবে বিদ্যুৎ খাতের ক্ষেত্রে জালানির প্রাইস সেট করার আগে কীভাবে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কমানো যায়, পাবলিক এন্টারপ্রাইজ, ট্যাক্স-ভ্যাট এগুলো নিয়ে যেই উদ্যোগগুলো নেয়া দরকার, সেগুলোও একই মনোভাব নিয়ে করা দরকার। এটা যেন ভাবা না হয় যে, শুধু সাময়িক সময়ের জন্য নিয়েছি এবং এরমধ্যে আইএমএফ এর ঋণ পেয়ে গেলেই এই সময়টা আমাদের জন্য স্বস্তি হবে। তা হবে না। কেন না এই উদ্যোগগুলো দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত আছে আমরা সংস্কার করছি না। এই কারণে আমরা অর্থনীতিতে বড় রকমভাবে ঝাঁকুনিটা খেয়েছি। সুতরাং এই উদ্যোগগুলো আমাদের নিজেদের তাগিদেই নেয়া দরকার।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমায় অর্থনীতি অবশ্যই ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ আমরা ইতিমধ্যেই রিজার্ভ সংকটে রয়েছি। এটি আরও কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে ডলার বিক্রি করলে রিজার্ভে তো ডলার থাকবে না। আর রিজার্ভ না থাকলে সব জায়গাতেই একটা আস্থাহীনতা তৈরি হবে।
সেজন্য আমাদের অনেক সতর্ক হতে হবে যাতে আস্থাহীনতার পর্যায়ে না যায়। প্রকৃত রিজার্ভ তো ২২ বিলিয়নের মতো, বরং আরও কম। আর এটা আইএমএফ এর টার্গেটের চেয়ে আড়াই বিলিয়ন কম। টার্গেট পূরণ করতে পারবে কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। সুতরাং খুব একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নাই। পলিসি ঠিক করা না হলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বর্তমানে যে কারেন্ট পলিসি সেটি এভাবে চললে অস্থিতিশীলতা কাটবে না। আরও খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। সব খাতেই সংকট চলছে। কিন্তু কোনোটিই সেভাবে অ্যাড্রেস করা হচ্ছে না। আর অ্যাড্রেস করা না হলে সংকট কাটবে না, বরং সংকট আরও বড় হতে পারে। আমরা চাই দেশের অর্থনীতি ভালোর দিকে যাক। কিন্তু সঠিক পলিসি না নিলে তো ভালোর দিকে যাবে না।