অবৈধ ও নকল সিগারেটে সয়লাব বাজার, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

অবৈধ ও নকল সিগারেটে সয়লাব বাজার, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সেই ক্ষতিকর পণ্য যদি অবৈধ বা নকলভাবে তৈরি করা হয়, তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এসব নকল সিগারেট তৈরির মূল হোতা হচ্ছে দেশের কিছু অসাধু চক্র। পাড়া-মহল্লার মোড়ের দোকান থেকে শুরু করে দেশের হাজার হাজার দোকান দেশি-বিদেশি নানা ব্র্যান্ডের অবৈধ ও নকল সিগারেটে সয়লাব।
এসব সিগারেট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হওয়ায় ক্রেতারাও এর মান নিয়ে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না।

কিন্তু নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কমে এগুলো কীভাবে বিক্রি হচ্ছে? এর কারণ হলো এসব সিগারেট জাতীয় রাজস্বে কোনো প্রকার অবদান রাখে না। ফলে, একদিকে সরকার যেমন হাজার-কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে কম দামে নিম্নমানের সিগারেট বাজারজাত হওয়ায় ধূমপান কমিয়ে আনার লক্ষ্যও অর্জন হচ্ছে না। 

জানা যায়, গত বছর ও চলতি বছরের চার মাসসহ এই ১৬ মাসে ৬১ কোটি ৫৪ লাখ অবৈধ সিগারেট ও নকল সিগারেট জব্দ করেছে কাস্টমস ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে চলতি বছরে সারা দেশে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭৫ লাখ ৬৮ হাজার শলাকা অবৈধ সিগারেট ও ৭৪ হাজার পাঁচ শ শলাকা নকল সিগারেট উদ্ধার করেছে। তাছাড়া গত বছর সারা দেশে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬০ কোটি ৭৭ লাখ শলাকা অবৈধ সিগারেট ও ৫০ হাজার শলাকা নকল সিগারেট উদ্ধার করা হয়। তবে অভিযানে যে পরিমাণ সিগারেট পাওয়া গেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অবৈধ ও নকল সিগারেট উৎপাদন এবং চোরাই পথে আমদানি করা হয় বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অবৈধ সিগারেট নিরাপদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসসহ নানা পদ্ধতি।
চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, যশোর, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে অবৈধ ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সিগারেট বাজারজাত করছে বেশ কয়েকটি অবৈধ কম্পানি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় কাস্টমস ও ভ্যাট গোয়েন্দারা অবৈধ ও নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট জব্দ করলেও এর মূল হোতারা এখনো নাগালের বাইরে। 

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে কমলালেবু আমদানির ঘোষণা দিয়ে আনা কোটি টাকা মূল্যের বিদেশি সিগারেট জব্দ করেছে কাস্টমস হাউজের অডিট, ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ জানায়, চালান ঘোষণার গড়মিল দেখে তারা কন্টেইনারটি পরীক্ষা করলে ১ হাজার ২৫০ কার্টন ল্যামার ও অস্কার ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট এবং ৩৮ কার্টন ‘ফ্রেশ ন্যাভেল অরেঞ্জ’ জব্দ করা হয়। এআইআর শাখা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, এই চালানের মাধ্যমে প্রায় ৩০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছিল।
 

এ ছাড়া, সিলেটের লালা বাজার, ইসলামপুর বাজার, শাগলী বাজারের মতো স্থানগুলোয় সরকারের বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। এনবিআর প্রতি ১০ শলাকা নিম্ন স্তরের সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য ৬০ টাকা, মধ্যম স্তরের ৮০ টাকা, উচ্চ স্তরের ১৪০ টাকা ও প্রিমিয়াম স্তরের মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারিত করেছে। অর্থাৎ, সরকার নিম্ন স্তরের শলাকা প্রতি ৬ টাকা, মধ্যম স্তরের শলাকা প্রতি ৮ টাকা, উচ্চ স্তরের শলাকা প্রতি ১৪ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরের শলাকা প্রতি সাড়ে ১৮ টাকা সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করেছে। 

কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা কম্পানিগুলো নকল ব্যান্ডরোল লাগিয়ে কিংবা কোনো ব্যান্ডরোল ছাড়াই বিভিন্ন ব্যান্ডের সিগারেট সরকারের এই নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে সরবরাহ করছে। যেমন; টি-২০, সেনার গোল্ড ও পোলো ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যান্ডের সিগারেট প্রতি শলাকা ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

এ সকল ব্র্যান্ড সরকারি কোষাগারে কোনো রাজস্ব প্রদান করে কিনা সেই অনুসন্ধানকালে রাজস্ব বোর্ডের এক সূত্র থেকে জানা যায়, সিগারেটের এসব অবৈধ বাণিজ্যের কারণে সরকার প্রতিবছর ১৫ শ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বাস্তবে এই ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ পর্যন্তও হতে পারে। 

এদিকে মুন-স্টার, পুষ্পা, স্কয়ার, গোল্ড, সিটি-গোল্ড, পার্লামেন্ট ইত্যাদি ব্র্যান্ডের সিগারেটও এভাবে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। আবার চোরাচালানকৃত বিদেশি ব্র্যান্ড যেমন; মন্ড, এলিগেন্স, প্যাট্রন, ইজি, ৫৫৫, গুদাং গারামের মতো সিগারেট হর-হামেশাই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। চোরাকারবারীরা দেশের সীমান্ত দিয়ে এসব অবৈধ সিগারেট দেশে নিয়ে আসে নানা রকম অভিনব উপায়ে। 

সম্প্রতি চট্টগ্রামের হালিশহর, নয়াবাজার, বউবাজার ও রামপুরা বাজারে অভিযান চালিয়ে চারটি অবৈধ কারখানা ও গুদাম থেকে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার পিস সিগারেট স্ট্যাম্প, ১৪৮টি সাদা বড় রোল, ৪২৫টি সাদা ছোট রোল, ১২৬টি কালো বড় রোল এবং ১ হাজার ৩৭টি কালো ছোট রোল জব্দ করা হয়েছে। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাটের কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার (আবগারী ও ভ্যাট বিভাগ) অনুপ দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, যদি আমাদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য থাকে যে স্থানীয় বাজারে এ ধরণের কার্যক্রম হচ্ছে তাহলে আমরা অভিযান চালাই। আমরা নিজেদের সরঞ্জামাদির মাধ্যমে ব্যান্ডরোল পরীক্ষা করি এবং পণ্য নকল বলে প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। 

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মুহাম্মদ নাহিদুন্নবী কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক অভিযান চালিয়ে থাকি। এ ছাড়া, সন্দেহজনক মনে হলে অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ ও নকল সিগারেট জব্দ করি। তিনি আরো বলেন, দেশের কিছু জায়গায় নকল সিগারেট তৈরি হচ্ছে এটা সত্য, কিন্তু দোষীদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। 

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চোরাইপথে আসার সময় চলতি বছরে প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ৬ লক্ষ ৭৩ হাজার ৯৯৮ প্যাকেট বিড়ি-সিগারেট জব্দ করা হয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী যে পরিমাণ চোরাই বিড়ি-সিগারেট জব্দ করে, প্রকৃতপক্ষে আরো কয়েকগুণ বেশি পণ্য দেশে প্রবেশ করে। 

দেশের রাজস্ব আয়ের অন্যতম তামাক খাত থেকে সরকার প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে। সরকার কর্তৃক প্রতিবছর বাজেটে মানভেদে সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেই নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ব্র্যান্ডের নির্ধারিত দাম সরকারের কাছে ঘোষণা করে এবং উৎপাদনের তথ্য প্রদান করে। এর ওপর ভিত্তি করে তারা সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন থেকে স্ট্যাম্প-ব্যান্ডরোল নিতে পারে।

তাছাড়া উৎপাদিত পণ্য কারখানা থেকে বের হওয়ার আগেই ট্যাক্স স্টাম্প অনুযায়ী সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা করা হয়। এটিই হচ্ছে বৈধ নিয়ম। সুতরাং, এতেই স্পষ্ট যে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই এই বৈধ প্রক্রিয়ার অর্ন্তভুক্ত হয় না। অসাধু কম্পানিগুলো যেমন সরকার নির্দেশিত মূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করছে, তেমন নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে ও চোরাচালানির মাধ্যমে আনা সিগারেট-ও  বাজারে  বিক্রি করছে। এতে সরকার প্রতিবছর যে বড় অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে, এ বিষয়ে সরকারকে আরো কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুতর প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।