অন্যের তথ্যে সিম তুলে প্রতারণা
২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দায়ের করা একটি মামলার তদন্তে এমন চাঞ্চল্যকর উঠে আসার পর চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ।
প্রথম নিউজ, ঢাকা : রাজধানীতে ভয়ংকর এক প্রতারক চক্রের সন্ধান মিলেছে। তারা একজনের তথ্য দিয়ে অন্যজনের নামে সিম কেনে এবং নগদ, বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলে। পরে সেই নাম্বার থেকে জ্বিনের বাদশাহ, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা বা বিকাশ-নগদ কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা করছে একটি চক্র।
২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দায়ের করা একটি মামলার তদন্তে এমন চাঞ্চল্যকর উঠে আসার পর চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- অনিক (২২), মো.রবিউল হোসেন (২৫), সাব্বির করিম আহাম্মেদ (৩৭), জোবায়ের আলম (৩৬), মোক্তার হোসেন (২৫), অন্তু দে (২২), ফজলুল করিম নাহিদ (৩৪)।
রোববার রাতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিরপুর মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন।
এসময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির ২১৪ সিম, একটি ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ৮টি, ট্যাব ২টি, বাটন ফোন ৫টি, ‘নগদ পকেট ডাক্তার’ সংবলিত ডিসকাউন্ট কার্ড ৫০০টি, ‘গ্রিন বাংলা আরকেআর’ লেখা সংবলিত কার্ড হ্যাঙ্গার, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, স্যালারি শিট ও টি শার্ট, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সিল, ভুয়া পুলিশ কার্ড, ভুয়া সাংবাদিক কার্ড, নগদ ডাক বিভাগের ডিজিটাল লেনদেনের কার্ড, বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র।
তিন ধাপে ভয়ংকর প্রতারণা
মিরপুর মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন জানান, তিন ধাপে প্রতারণার কাজ করে থাকে চক্রটি। প্রতিটি ধাপেই আলাদা আলাদা গ্রুপ থাকে। প্রথম ধাপে একটি গ্রুপ বিভিন্ন মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র, আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে। এই গ্রুপ তাদের এসব তথ্য দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়।
দ্বিতীয় ধাপে আরেকটি গ্রুপ এসব তথ্য দিয়ে এসব নামে সিম কেনে এবং বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে। এরপর এসব সিম তারা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেয় তৃতীয় গ্রুপের কাছে। তারা এসব সিম ব্যবহার করে কখনও জ্বিনের বাদশাহ, কখনও বিকাশ বা নগদ এজেন্ট, আর কখনও বা বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা সেজে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে।
অরুণার মোবাইল নেই, কিন্তু তার নামে রয়েছে সিম, বিকাশ ও নগদ একাউন্টও!
২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানায় বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণার একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলার তদন্তে গিয়ে আটক করা হয় অরুণা নামে একজনকে। কিন্তু তিনি জানান, তার কোনো মোবাইল নেই, তিনি কোনো মোবাইলই ব্যবহার করেন না। তাই তার কাছে কোনো সিম নেই। কোনো বিকাশ কিংবা নগদ একাউন্টও নেই। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় নিশ্চিত হওয়া যায়- এই ঘটনার সঙ্গে অরুণার যোগসাজশ নেই। কারণ, অরুণা ঢাকায় থাকলেও সেই সিমের অবস্থান রাজশাহীতে।
অরুণাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সরকার স্বল্পমূল্যে চাল, ডাল, তেল দেবে বলে কিছুদিন আগে তাদের বাসায় কয়েকজন মানুষ আসে। তারা এজন্য তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, আইরিশ (চোখের ছাপ) ও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে যায়। কিন্তু এরপর তারা আর আসেননি।
ওসি মোহাম্মদ মোহসীন বলেন, মূলত স্বল্পমূল্যে চাল, তেল দেওয়ার নাম করে তাদের তথ্য হাতিয়ে নিয়েছিল অনিকের গ্রুপ। তাদের যেন মানুষ সন্দেহ না করে এজন্য তারা মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বাসায় আটার প্যাকেট, তেলের বোতলও সঙ্গে নিয়ে যেত। সবাই প্রতিষ্ঠানের লোগো সম্বলিত একই ধরনের টি শার্টও পরতো।
প্রতারক চক্রে মোবাইল ব্যাংকিং কর্মকর্তাও!
ভয়ংকর এই প্রতারক চক্রের দুই সদস্য চাকুরি করেন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশেও। গ্রেপ্তার জোবায়ের ও সাব্বির বিকাশের ডিএসএস (ডিস্ট্রিবিউটর সেলস সুপারভাইজার) এবং মোক্তার হোসেন ও অন্তু দে ডিএসও (ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার)। তারা তাদের কাছে থাকা পাসওয়ার্ড এজেন্টের কাছে দিয়ে দেন। ফলে এজেন্ট সহজেই অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলতে পারে।
তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেওয়া মাসিক টার্গেট পূরণের জন্যই তারা এভাবে এই প্রতারক চক্রকে ‘সহযোগিতা’ করেছেন।
৫০ টাকার সিম ৫ হাজার টাকা!
সাধারণত একটি সিমের দাম ৫০ টাকা বা তার কিছু কমবেশি হয়। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সিম ১০০ টাকায়ও বিক্রি হয়। কিন্তু এ প্রতারক চক্রের সিমের দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তারা যে সমস্ত সিম প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে অন্য প্রতারক চক্রের কাছে। যেহেতু এসব প্রতারক চক্র জ্বিনের বাদশাহ, বিকাশ, নগদ প্রতারণাসহ অন্যান্য প্রতারণার কাজে এসব সিম ব্যবহৃত হয়, তাই তাদের কাছে এসব সিমের খুব চাহিদা। এসব সিম তারা এক হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে কিনে থাকেন।
তারা কখনও জ্বিনের বাদশাহ, কখনও পুলিশের এসপি!
প্রতারণার মাধ্যমে সংগৃহীত এসব সিম দিয়ে চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন মানুষকে ফোন করে টাকা হাতিয়ে নেয়। তারা কখনও জ্বিনের বাদশাহ সেজে ফোন দেয়। কখনও পুলিশের এসপি সেজে মামলা থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার কখনো বিকাশ কিংবা নগদের কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা করে। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।
গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলার তদন্তে এসব তথ্য জানতে পারে পুলিশ।