২৫ সালেই ভোটের সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি, দিতে হবে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ

প্রথম নিউজ, অনলাইন: আগামী বছর, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। বিএনপির পাশাপাশি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরও একই চাওয়া।
‘২০২৫ সালের শেষের দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়’, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যকে সাধুবাদ জানালেও দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে সংশয় তৈরি হয়েছে এ ঘোষণায় তা কাটবে না। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নির্বাচনের সময়ের প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীলরা বলছেন, উপদেষ্টার বক্তব্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন তাঁরা। অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে নির্বাচনমুখী করতে না পারলে দেশবিরোধী নানা ধরনের অপপ্রচার-ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে। পতিত সরকার দেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাবে। বিএনপি মনে করে, আগামী বছরের প্রথমার্ধে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে পরবর্তী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
সর্বোচ্চ ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ হলে তাতে আপত্তি থাকবে না। তবে নির্বাচন ২০২৬ সালে গেলে সেটি হবে দীর্ঘ সময়। এর মধ্য দিয়ে সময় ক্ষেপণ হবে, যেটি কাম্য নয়।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অভিমত, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।
বিএনপি তাদের ৩১ দফায়ও সংস্কারের কথা বলেছে। তাই নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত। এর অংশ হিসেবে দ্রুত রোডম্যাপ দিলে দেশ পুরোপুরি নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ঢুকে যাবে। এতে বিদ্যমান অস্থিরতাও কেটে যাবে।
তা ছাড়া ১৫-১৬ বছর ধরে ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণও এখন ভোট দিতে উন্মুখ।
আর সব সংস্কার শেষে নির্বাচন করতে গেলে সেটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। নির্বাচিত সরকার এসে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেবে। এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণার পর বিএনপি সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন করতে এত সময় লাগার কথা নয়। সরকার আন্তরিক হলে আরও দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। জনগণ দ্রুত নির্বাচন প্রত্যাশা করে। অংশীজনেরাও দ্রুত নির্বাচন চায়। জবাবদিহিমূলক সরকার না থাকলে অংশীজনেরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের একটি ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি ধারণা নয়, নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। তিনি বলেন, সংস্কার যুগ যুগ ধরে চলবে, এটা নতুন কিছু নয়। সময়ের বিবর্তনে, সময়ের চাহিদায় সংস্কার প্রয়োজন হয়। আমরা আশা করছি, এ সরকার দ্রুততম সময়ে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফেরত দেবে, এটাই কাম্য।
বিএনপির একসময়ের রাজপথের মিত্র জামায়াতে ইসলামী বলছে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের একটা ধারণা দিলেও সংস্কারের বিষয়ে কিছুই বলেননি। জামায়াত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন চায়। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন চাই। তিনি বলেন, জনগণের প্রত্যাশা ফ্যাসিবাদমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে ন্যায়বিচার কায়েম হবে।
মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করবে। এসব নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই বিগত সরকারের প্রতিটি সেক্টরের অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরই নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোও রোডম্যাপ প্রশ্নে এখন সরকারপ্রধানের সঙ্গে সংলাপ আশা করছে। তারা বলছে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এরপর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে রোডম্যাপ তৈরি করা হলে সব সন্দেহ-সংশয় দূর হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, নির্বাচনের সময় নিয়ে এখন যে ইঙ্গিত পাওয়া গেল, সেটা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরিতে সহায়ক হবে। এখন অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার এবং নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে এটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় সংস্কার শেষ করে একটি নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা আশা করেছিলাম। তার পরও যেটা বলেছেন, আমরা মনে করি, তিনি সামনে আরও সুন্দরভাবে, আরও নির্দিষ্টভাবে একটি পরিকল্পনা আমাদের সামনে তুলে ধরবেন। আমরা চাই এ সরকার সফল হোক।
বিএনপির মিত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ দেখতে চাই না। মানুষ ১৭ বছরে ভোট দিতে পারেনি।
বর্তমান সরকার দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মো. ফারুক রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সম্ভাবনার কথায় দেশবাসী আস্থা রাখতে পারছে না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের স্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। দেশে এখন নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এ ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দ্রুত একটি নির্বাচিত সরকার দরকার। যত দ্রুত নির্বাচন হবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল।
বিএনপির আরেক মিত্র ১২-দলীয় জোটের নেতারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চার মাস পার হওয়ার পর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে বক্তব্য এলো। কিন্তু তাতে সংস্কারের সময় বা নির্বাচনের তারিখ বলা হয়নি। এ জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন বলেন, এখন দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা প্রয়োজন। তাঁরাসহ অনেক দল ২০২৫ সালে জুনের মধ্যে নির্বাচন চায়। তাঁরা মনে করেন, সংস্কার করবে রাজনৈতিক সরকার।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘জনগণকে সঙ্গে রাখুন, সঙ্গে থাকুন। আমরা ডামির নির্বাচনে বিশ্বাস করি না। আমরা রাজনৈতিক দল, নির্বাচন চাইব- এটাই স্বাভাবিক। জনগণ যাকে সমর্থন দেবে তাকে ভোট দেবে।
তারা ক্ষমতায় যাবে, এটা কোনো ব্যাপার না। আমরা আমি-ডামি বা ভোট ডাকাতির নির্বাচনে বিশ্বাসী না। মানুষ যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে এটা আমাদের চাওয়া। মানুষ যখন মুক্তভাবে ভোট দেব তখন অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ভোট দেবে।
এর জন্য জনগণের আস্থা আপনার পক্ষে রাখতে হবে।’
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ৩১ দফা বাস্তবায়নে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কর্মশালায় অংশ নিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভার্চুয়ালি এসব বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘স্বৈরাচারের মাথা পালিয়ে গেছে কিন্তু তাদের লেজ রয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে সচেতন থাকতে হবে।
আমাদের ভেতরেও এজেন্ট ঢুকে গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে। কেউ যদি ভাবে প্রতিপক্ষ পালিয়েছে, নির্বাচন সহজ হবে- তা না। নির্বাচন অনেক অনেক কঠিন হবে। জনগণের সমর্থন নিয়ে আমরা এ নির্বাচন পার করতে চাই।
’
তারেক রহমান বলেন, ‘মানুষ যখন জানে আপনি বিএনপির রাজনীতি করেন তখন মানুষ আপনাদের সালাম দেয়, জিজ্ঞেস করে ভাই নির্বাচন কবে হবে। ব্যবসায়ীরা বলেন, ভাই নির্বাচন কবে হবে, নইলে তো ব্যবসা ঠিকমতো হচ্ছে না। এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, কারণ মানুষের প্রত্যাশা আপনাদের কাছে। তাদের বিশ্বাস বিএনপি ভালো কিছু করতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো মানুষের আস্থা অর্জন করা। আপনার মতো অনেক মানুষই তো আছে, কয়জনের সঙ্গে মানুষ এভাবে কথা বলছে। আপনার সঙ্গে এমন ব্যবহারের কারণ আপনি বিএনপি করেন। আপনার কাজকর্মের সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ জড়িত।’
তিনি আরো বলেন, ‘মানুষের আস্থা অর্জনই একটি রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় সফলতা। এই বিশ্বাস এই আস্থা ধরে রাখার দায়িত্ব জনগণের নয়। এই আস্থা ধরে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। আপনার এলাকায়- আপনাকে দিয়ে মানুষ বিএনপিকে বিচার করবে। আপনি ভালো হলে বিএনপি ভালো, আপনি খারাপ হলে বিএনপি খারাপ। আপনাদের দিয়েই মানুষ বিএনপিকে বিচার করবে।’
তিনি বলেন, ‘যারা অপকর্ম করবে শক্ত হাতে তাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। আপনারা আজ এখানে নেতা হিসেবে এসেছেন। আপনাদের অধীনে অনেক লোক আছে। খেয়াল রাখবেন, নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কেউ যেন দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে না পারে ‘
তারেক বলেন, ‘আজকে আমাদের ৩১ দফার কর্মশালা পর্ব, এটা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এর আগে কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ও বিভাগীয় পর্যায়ে এ কর্মসূচি করেছি। আপনারা সারা দিন যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর সবগুলোই ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। আপনারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, মিশছেন, দেখছেন। আপনারা জানেন, কিভাবে জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনে মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল। তাদের জন্যেই এই ৩১ দফা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সরকার গঠন করতে হবে জনগণের সমর্থন নিয়ে। তা না হলে আমাদের এত বছরের আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমরা দেশ নিয়ে যে কর্মসূচি দিয়েছি এর জন্য আমাদের জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। এর জন্য আমাদের সঠিক কাজটি করতে হবে এবং অনৈতিক কাজ পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের সফলতা হলো মিছিলে জনগণের অংশগ্রহণ। আমাদের জনগণের সমর্থন যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে।’
এ সময় জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু, বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকনসহ নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।