হকারদের দখলে ঢাকার ফুট ওভারব্রিজ, চলাচলবান্ধব নয় সিঁড়ি

রাজধানীর বেশিরভাগ ফুট ওভারব্রিজ পথচারীদের চলাচলবান্ধব নয়। দুর্ঘটনা এড়াতে এবং পথচারীদের পারাপারে সুবিধার জন্য এগুলো স্থাপন করা হলেও এখন তা হকারদের দখলে।

হকারদের দখলে ঢাকার ফুট ওভারব্রিজ, চলাচলবান্ধব নয় সিঁড়ি

প্রথম নিউজ, ঢাকা: রাজধানীর বেশিরভাগ ফুট ওভারব্রিজ পথচারীদের চলাচলবান্ধব নয়। দুর্ঘটনা এড়াতে এবং পথচারীদের পারাপারে সুবিধার জন্য এগুলো স্থাপন করা হলেও এখন তা হকারদের দখলে। ফুট ওভারব্রিজের দুই পাশে হকারদের দোকান থাকায় পথচারীদের চলাচলের পথ হয়েছে সরু। এতে নিরাপদে রাস্তা পারাপারে সমস্যায় পড়েন পথচারীরা। পাশাপাশি ফুট ওভারব্রিজে ওঠার সিঁড়ির ধাপগুলো চলাচলবান্ধব না হওয়া এবং সিঁড়ি অপ্রয়োজনীয় উঁচু হওয়ায় রাস্তা পারাপারে অনেকেই এগুলো এড়িয়ে চলেন। ফলে এসব ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের প্রকৃত সুফল মিলছে না।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নে সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমইডি। এতে ফুট ওভারব্রিজ থেকে হকার উচ্ছেদ করে জনগণের চলাচল সুগম করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়।

আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হকাররা অবৈধভাবে ফুটপাত ও ফুট ওভারব্রিজ দখল করে ব্যবসা পরিচালনা করায় পথচারীদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। এতে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে হাঁটার রাস্তা। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ফুট ওভারব্রিজ দেখতে যথেষ্ট নান্দনিক হলেও দিনে তা থাকে হকারদের দখলে। এছাড়া রাতে কোনো কোনো ফুট ওভারব্রিজে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। এসব কারণে অনেকেই রাস্তা পারাপারে ফুট ওভারব্রিজ এড়িয়ে চলেন। ফলে এসব ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের প্রকৃত সুফল পাচ্ছে না জনগণ।

প্রতিবেদনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি ফুট ওভারব্রিজে হকার ও অপরাধীদের দখলের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শাহজাহানপুর, শ্যামলী, কমলাপুর পীরজঙ্গী মাজার সংলগ্ন ফুট ওভারব্রিজ। এছাড়াও রয়েছে মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজ, বসুন্ধরা শপিংমল, সোবহানবাগ মসজিদের নিকট, নর্দ্দা-বারিধারা বাসস্ট্যান্ড ও উত্তর বাড্ডা বাজার ফুট ওভারব্রিজ।

এসব ফুট ওভারব্রিজ সবসময়ই থাকে হকারদের দখলে। বনানী-১১ নম্বর রোডের ফুট ওভারব্রিজের চলন্ত সিঁড়ি থাকলেও তা সচল থাকে না সবসময়। ফলে এই ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে সমস্যায় পড়েন বয়স্ক ও শিশুরা। এসব সমস্যা সমাধানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমরা প্রকল্পটি পরিদর্শন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করেছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা বৈঠক করবো। আলাদাভাবে সুপারিশ করে বিষয়গুলো জানতে চাইবো। এগুলোর বিষয়ে পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা জানতে চাইবো। বই আকারে প্রতিবেদন দিলে তেমন কোনো কাজ হয় না, অনেকে বই নিয়ে রেখে দেয়। তবে আশা করছি বৈঠক করে চিঠি দিলে কিছু কাজ হবে। যাতে করে একই ব্যত্যয় বার বার না হয় সেই বিষয়েও আমরা সুপারিশ করবো।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগরীর তেজগাঁও, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর ও পুরাতন ঢাকা এলাকায় ৭৮ কিলোমিটার রাস্তা, ফুটপাত ও নর্দমা উন্নয়ন করা হয়। এই প্রকল্পের অধীনে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে পথচারীবান্ধব ২৩টি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। একই সঙ্গে ৩৯টি সড়ক বিভাজক উন্নয়ন, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে ট্রাফিক সিগন্যাল আধুনিকীকরণ, সিভিল ওয়ার্কস এক্সেসরিজ রক্ষণাবেক্ষণ, লাইটিং ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়।

এছাড়াও ১৩টি ফুট ওভারব্রিজ এলাকায় সিগন্যাল অবকাঠামোর উন্নয়ন, পুরাতন ক্যাবল কানেকশন সংস্কার, রোড মার্কিং ও রোড সাইন (৯২টি ইন্টারসেকশনে), সাইডওয়ার্ক, ড্রেনেজ ও সড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার। পাশাপাশি বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি। টার্ম কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে পূর্ত কাজ (সাইড ওয়াক ও অন্যান্য মেরামত) হয়েছে ৭০ কিলোমিটার। এছাড়াও রাজধানীর ৫ লোকেশনে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ভৌত কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে।

এই প্রকল্পের কাজ এবং এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন আইএমইডি সমীক্ষার পরামর্শকরা। তারা প্রকল্প এলাকায় রাস্তা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজ এবং সংযোগ সড়ক কার্যকর অবস্থায় দেখতে পান। তবে পরামর্শকরা দেখতে পান- অনিয়ন্ত্রিত পার্কিং, ফুটপাত দখল, ড্রেন পরিষ্কার না করা এবং ফুট ওভারব্রিজ হকারদের দখলে থাকায় জনসাধারণ প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে না। তাছাড়া ফুটপাত কোথাও উঁচু বা নিচু হওয়ায় পথচারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারছেন না।

সমীক্ষার পরামর্শকরা দেখতে পান, সব স্থানে ফুটপাতের প্রশস্ততা সমান নয়, ফলে পথচারীদের চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়ও যানজটের সময় মোটরসাইকেল ফুটপাতে উঠে যায়, এতে পথচারীদের চলাচলে সমস্যা হয়। প্রকল্পের আওতায় ট্রাফিক সিগন্যাল নির্মাণ, স্বয়ংক্রিয় রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম ও ট্রাফিক সিগন্যালে সোলার প্যানেল সিস্টেম চালু করা হলেও প্রায় সবক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ হাত দিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। এর ফলে ট্রাফিক সিগন্যাল, স্বয়ংক্রিয় রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম ও সোলার প্যানেল অকার্যকর ও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রকল্পের আওতায় যাত্রী ছাউনি নির্মিত হলেও কিছু কিছু স্থানে যাত্রী ছাউনির ভেতরে দোকান গড়ে উঠেছে। ফলে সেগুলো এখন আর যাত্রী ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।

প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ছিল ২০০৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৪৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৩৯৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় সময় বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। এরপর এই প্রকল্পের সময় ও ব্যয়- দুটোই বাড়ে। সময় বাড়ানোর পর দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকল্পে বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০০৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ৩০ জুন। সংশোধনের পর প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৫২৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

তবে এই মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফায় সময় বাড়িয়ে ৩য় সংশোধিত প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৮০২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৯ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পের মূল প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৮০ দশমিক ৩৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে এরই মধ্যে। সময় বাড়ানো হয় ৫ বছর, যা মূল সময়ের ১০০ শতাংশ বেশি। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময় ও অর্থের ব্যয় বেশি হয়েছে।

নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প হলো বায়ুর গুণগতমান ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের ফলোআপ। যা একটি লার্নিং অ্যান্ড ইনোভেশন লোন (এলআইএল) প্রকল্প হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। বায়ু দূষণ কমাতে এবং ইট তৈরিতে দক্ষ প্রযুক্তি প্রবর্তনের মাধ্যমে মূল দূষণকারী খাতসমূহে (পরিবহন এবং ইট তৈরি) টেকসই পরিবেশগত উদ্যোগ (এসইআই) গ্রহণকে ত্বরান্বিত করা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও রাজধানী ঢাকায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের মতো গণপরিবহন চালুর ভিত্তি স্থাপন, যানজট কমিয়ে আনা এবং গণপরিবহন (বাস) খাতে সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন ও সংস্কারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যৌথভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ইট তৈরি ও পরিবহন খাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তবে এ প্রকল্পের আওতায় ফুট ওভারব্রিজসহ বেশকিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি।