নির্বাচন কমিশন গঠন: তালিকায় অনেক ‘সুবিধাভোগী’
সোমবার রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে ৩১৫ জনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: রাজনৈতিক দলের পছন্দ ও বিশিষ্টজনের পরামর্শে নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির তালিকায় অনেক 'সুবিধাভোগী'র নাম রয়েছে। এমনকি আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে নিজ নিজ এলাকায় দৌড়ঝাঁপ করছেন এমন ব্যক্তিদেরও নাম আছে সেখানে। সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠকে নাগরিক সমাজের দাবি ছিল, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিশেষ আনুকূল্য পাওয়া ব্যক্তিরা যেন কমিটির সুপারিশের বাইরে থাকেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) নতুন নির্বাচন কমিশনের পাঁচটি পদে ১০ জন যোগ্য ব্যক্তি খুঁজতে গঠিত সার্চ কমিটি গত ১০ দিন ধরে কাজ করে চলছে। সোমবার রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে ৩১৫ জনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও নাগরিক সমাজের দাবি, কে কোন নাম দিয়েছেন অর্থাৎ প্রস্তাবকারীদের নামসহ তালিকা প্রকাশ করা হোক। এ ছাড়া তারা সার্চ কমিটির চূড়ান্ত ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর আগে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। এর আগে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কয়েক দফা বৈঠকে নানা পরামর্শ শুনেছে সার্চ কমিটি।
গতকালও দেশের শীর্ষস্থানীয় চার সম্পাদকের সঙ্গে তারা বৈঠক করেছেন। সদ্য সংসদে পাস হওয়া ইসি গঠন আইন অনুযায়ী ৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মোট ১৩৬ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। পেশাজীবী সংগঠন দিয়েছে ৪০ জনের নাম। নির্ধারিত ই-মেইলে এসেছে আরও ৯৯ জনের নাম, আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে নাম প্রস্তাব করেছেন ৩৪ জন। এ ছাড়া বিশিষ্টজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময়ও বেশকিছু নামের প্রস্তাব পেয়েছে সার্চ কমিটি। এসব নাম একত্র করেই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
এই তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে 'বিশেষ সুবিধাভোগী' বেশ কয়েকজন আমলার নাম রয়েছে এতে। সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে সচিব হন। তার এই পদোন্নতি প্রশাসনে ব্যাপক আলোচিত ছিল। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব ড. আব্দুল মজিদ বর্তমান সরকারের আমলে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তারও নাম রয়েছে এই তালিকায়।
সাবেক সচিব কামরুন নাহার (তথ্য ক্যাডার) বর্তমান সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতির কোঠায় সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে দুটি মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার স্বামী বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম যিনি দ্বিতীয় দফা চুক্তিতে রয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাধিকবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সাবেক আমলাদের মধ্যে তালিকায় নাম রয়েছে সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সাবেক সচিব আবদুল মালেক, সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল, সাবেক সচিব মো. মহিবুল হক, সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর ও সাবেক সচিব ড. জাফর আহমেদ খানের।
এ ছাড়া তালিকায় নাম থাকা সাবেক শ্রম সচিব মিকাইল শিপার আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া আরেক আমলা মোহাম্মদ আব্দুল করিমের নাম রয়েছে, যিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব পদ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া মোস্তাফা কামাল উদ্দিনের নাম রয়েছে ৩১৫ জনের তালিকায়।
সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে সরকারের বিশেষ পছন্দের ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। এই তালিকায় নাম রয়েছে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি নির্বাচন কমিশন সচিব পদে দায়িত্বে ছিলেন। ওই ভোটে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ ছাড়া পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ, পিএসসির সাবেক সচিব ও সদস্য মো. শাহজাহান আলী মোল্লা, সাবেক সদস্য উজ্জল বিকাশ দত্তের নামও এসেছে তালিকায়।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, তালিকায় নাম থাকা সাবেক সচিব জিল্লার রহমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি আসন থেকে একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তিনি ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি পদে কাজ করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।
একইভাবে সাবেক সচিব মো. আনসার আলী খান কুষ্টিয়ার একটি আসন থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী বলে জানা গেছে। তালিকায় নাম থাকা সাবেক ধর্ম সচিব মো. নুরুল ইসলাম দিনাজপুরের একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী এবং পাবনা জেলার একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী অতিরিক্ত আইজিপি কৃষিবিদ ইকবাল বাহার।
এ ছাড়া সাবেক সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পিতা আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ছিলেন। তার নামও রয়েছে এই তালিকায়। সাবেক সচিব মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরী বর্তমান সরকারের আমলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। তার স্ত্রী নাছিমা বেগম এখন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তার নাম রয়েছে ৩১৫ জনের তালিকায়।
এ ছাড়া তালিকায় নাম রয়েছে ইসি কার্যালয়ের সদ্য পদত্যাগী যুগ্ম সচিব মো. আবুল কাসেমের। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া আবুল কাসেম সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আশ্বাসে দ্রুত পদত্যাগ করেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। নতুন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেতে তিনি ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশনের আমলে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: