সপ্তাহে ৩০ হাজার টাকা কিস্তি দিতেন সেই রঞ্জু

সপ্তাহে ৩০ হাজার টাকা কিস্তি দিতেন সেই রঞ্জু

প্রথম নিউজ, শাহজাদপুর : প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কয়েক লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া জনতা ব্যাংকের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর শাখার পরিচ্ছন্নতাকর্মী আওলাদ হোসেন রঞ্জুকে (৪৫) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার (১০ জুলাই) ভোর ৬টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পূর্ব মিয়াপাড়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

গ্রেপ্তারের পরে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করেছেন রঞ্জু। তিনি শাহজাদপুর পৌরসভার পাড়কোলা গ্রামের মৃত নুরুল আকন্দের ছেলে। পাঁচ ভাই ও


মঙ্গলবার (১১ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শাহজাদপুর থানায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শাহজাদপুর সার্কেল) মো. কামরুজ্জামান। 

তিনি জানান, গত ৬ জুলাই জনতা ব্যাংকের শাহজাদপুর শাখার আবু হানিফ নামে একজন গ্রাহক ওই ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য আসেন। চেক জমা দেওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে, তার অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। গত ২ মে তিনি অত্র ব্যাংকে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মী আওলাদ হোসেন রঞ্জুর মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা জমা দেন। এরপর তিনি ব্যাংকের ম্যানেজারকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে ম্যানেজার জানতে পারেন যে, আওলাদ হোসেন রঞ্জু ঈদের ছুটির পর থেকে ব্যাংকে অনুপস্থিত আছেন এবং উক্ত তারিখে হানিফের কোনো জমা ভাউচার নেই। 

এরপর রঞ্জুর অনুপস্থিতির বিষয়টি জানাজানি হলে গ্রাহকরা ব্যাংকে আসতে শুরু করেন। উক্ত ঘটনায় ম্যানেজার জেহাদুল ইসলাম শাহজাদপুর থানায় ৬ জুলাই একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (ডায়েরি নং ৩২৭)। পরবর্তীতে ম্যানেজার জানতে পারেন যে, আওলাদ হোসেন রঞ্জু দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যাবলীর অগোচরে ব্যাংকের সিল ও স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ২৫ জন গ্রাহকের প্রায় ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। এ ঘটনা ম্যানেজার জেহাদুল ইসলাম বাদী হয়ে গতকাল ১০ জুলাই শাহজাদপুর থানায় একটি প্রতারণার মামলা করেন (মামলা নং- ২৩)। 

এরপর শাহজাদপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান ও শাহজাদপুর থানার ওসির তত্ত্বাবধানে শাহজাদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোপাল চন্দ্র মন্ডলের নেতৃত্ত্বে পুলিশের একটি টিম গোপালগঞ্জ থেকে ঘটনার মূলহোতা আওলাদ হোসেন রঞ্জুকে গ্রেপ্তার করেন। এ সময় তার কাছ থেকে নগদ ২৪ হাজার ২০ টাকা ও একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। 

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, রঞ্জু ১৯৯৯ সালে এইচএসসি পাস করেন এবং ২০০১ সালে বিকম পরীক্ষা দেন। কিন্তু পর পর তিন বার পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেননি। তিনি ২০০২ সালে স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০০৩ সালে জনতা ব্যাংক শাহজাদপুর শাখায় চুক্তিভিত্তিতে তিনি পিওন কাম পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে তিনি তার কাজের পাশাপাশি ডেসপাচ কাজ শুরু করেন এবং ব্যাংকের প্রবেশ দ্বারে একটি ডেস্ক স্থাপন করেন। তিনি তার কাজের পাশাপাশি যখন কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে আসতেন তখন তার ফরম পূরণ করে দিতেন। 

এমতাবস্থায় ২০১৬ সালের দিকে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকজনের কাছে চড়া সুদে আনুমানিক ১৫ লাখ টাকা ঋণ নেন। এরপর উক্ত ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য তিনি টিএমএসএস, ব্রাক, আশা, দিশাসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা ঋণ নেন। তাকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হতো। এরপর তিনি ২০২২ সালের শুরুর দিকে গ্রাহকদের কাছ থেকে জালিয়াতি করে টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। 

পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তার পরিচিত লোকদের টার্গেট করেন এবং তাদের অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। তার গ্রাহকরা তাকে বিশ্বাস করতেন এবং তার পরিচিত টার্গেট অ্যাকাউন্টের কেউ টাকা জমা ও উত্তোলন করতে আসলে তার মাধ্যমেই করতেন। কোনো গ্রাহক টাকা তুলতে আসলে তারা যে টাকার পরিমাণ লিখত তার বাম পাশে গোপনে তিনি একটি ডিজিট বসিয়ে বেশি টাকা তুলতেন। আবার মাঝে মাঝে তিনি চেক নিজের কাছে রেখে তার কাছে থাকা টাকা দিয়ে দিতেন। পরে সুবিধামতো সময়ে চেক দিয়ে বেশি টাকা উত্তোলন করতেন। আবার তার পরিচিত কেউ যখন টাকা জমা দিতে আসতেন তখন তার কাছে টাকা দিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু তিনি উক্ত টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রাখতেন এবং পরের দিন গ্রাহককে ভুয়া জমা রশিদ দিতেন। 

এর আগে গতকাল (১০ জুলাই) আওলাদ হোসেন রঞ্জুর মা আনোয়ারা খাতুন ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেন, তার ছেলেকে ব্যাংকের ওই শাখার ম্যানেজার জেহাদুল ইসলাম জোর করে ১৫ দিনের ছুটিতে পাঠান এবং তারপরে তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শাহজাদপুর সার্কেল) মো. কামরুজ্জামান মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল ঢাকা পোস্টের একটি প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উঠে এসেছে। বিষয়টি আমার নজরে এসেছে, আমরা বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত করছি। 

তিনি বলেন, আমরা অল্প সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পেয়েছি। এরপরেও আমরা তদন্ত করে দেখছি তার সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত আছে কিনা। এছাড়াও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করছে। তারাও জানার চেষ্টা করছে এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কি না।