সেন্টমার্টিন সৈকতে আড়াইশ’ অবৈধ দোকান, মাসে ৮ লাখ টাকা চাঁদাবাজি
দ্বীপের উত্তর পূর্ব, পশ্চিম ও কোনাপাড়া সৈকত দখল করে বসানো হয়েছে আড়াই শতাধিক অবৈধ দোকানপাট।
প্রথম নিউজ, সেন্টমার্টিন: প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের সৈকতে হাঁটার পথ নেই। দ্বীপের উত্তর পূর্ব, পশ্চিম ও কোনাপাড়া সৈকত দখল করে বসানো হয়েছে আড়াই শতাধিক অবৈধ দোকানপাট। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ১০০-১৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। হিসাবে প্রতি মাসে আট লক্ষাধিক টাকা চাঁদা তোলা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, চাঁদার বড় একটি অংশ যায় স্থানীয় ট্যুরিস্ট পুলিশের পকেটে। কিছু যায় যারা চাঁদা তোলে তাদের পকেটে। চাঁদা না দিলে দোকান তুলে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় মাসের পর মাস চাঁদা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার কথা স্বীকার করেছেন দোকানিরা।
দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিদিনই সেন্টমার্টিন সৈকতে গড়ে উঠছে অবৈধ দোকানপাট ও স্থাপনা। এতে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সৈকত। এসব দোকানের ময়লা-আবর্জনা ও পর্যটকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলায় দূষিত হচ্ছে সৈকত ও পরিবেশ। পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশ নিয়মিত তদারকি না করায় সৈকত দখল করে দোকানপাট বানাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। তবে ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা এসব দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা পান। এজন্য তারা এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত ১০ জন দোকানি জানিয়েছেন, প্রতিদিন ১০০-১৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা তোলার দায়িত্বে আছেন কয়েকজন লাইনম্যান। তাদের দিয়ে চাঁদা তোলান ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা। আড়াই শতাধিক দোকানিকেই চাঁদা দিতে হয়। কাউকে ১০০ আবার বড় দোকান হলে ১৫০ টাকা দিতে হয়। কিছু দোকান থেকে মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে মাসে আট লাখ টাকার বেশি চাঁদা তোলা হয়। তবে চাঁদা তোলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
এদিকে, ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন এলাকাকে সংকটাপন্ন ঘোষণা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। কিন্তু সেই গেজেট তোয়াক্কা না করে ওই এলাকায় প্রতিদিন গড়ে উঠেছে হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপনা। এতে বিপন্ন হওয়ার পথে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সেন্টমার্টিনের উত্তর, পূর্ব পশ্চিম সৈকতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠা অবৈধ মাছের ফিশারিজসহ প্রায় অর্ধশতাধিক দোকানপাট উচ্ছেদ করেছে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর। এর মধ্যে ছিল বসতবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) মো. নাসিম আহমেদ, টেকনাফের ইউএনও পারভেজ চৌধুরী ও পরিবেশ অধিদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদা পারভীন। এ বিষয়ে নাসিম আহমেদ বলেন, ‘সেন্টমার্টিন রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের দেওয়া ১৩টি সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই অভিযান চলমান।’
সরেজমিনে দেখা যায়, সেন্টমার্টিন সৈকতের উত্তর থেকে পূর্ব-পশ্চিম ও কোনাপাড়ার চলছে দখলের মহোৎসব। বেলাভূমি দখল করে কাঠ-টিন দিয়ে দোকানপাট নির্মাণ করছেন স্থানীয়রা। বর্তমানে সৈকতে আড়াইশ'র বেশি অবৈধ দোকানপাট রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তোলা হয়।
সৈকতের পশ্চিম পাশের দোকানি মো. রফিক ও আনজুমান জানান, পর্যটক মৌসুমে আমরা এখানে প্রতি বছর ব্যবসা করি। অন্য বছরের চেয়ে এবছর ব্যবসা ভালো। এখানে আড়াইশ দোকানি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনও সময় কেউ বাধা দেয়নি। ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রতিনিধিরা আমাদের কাছ থেকে দিনে ১০০-১৫০ টাকা নেন। কখনও কখনও ট্যুরিস্ট পুলিশ নিজেরাই নেয়। তবে সম্প্রতি দ্বীপে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শুনছি। এ নিয়ে আতঙ্কে আছি। কারণ চাঁদা দিয়ে হলেও দোকান করে আমাদের সংসার চলে। উচ্ছেদ করে দিলে আমরা বেকার হয়ে যাবো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানদার বলেন, ‘ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা এসে চাঁদা নেন। মাঝেমধ্যে তাদের প্রতিনিধিরা এসেও টাকা তোলেন। আরেক দোকানি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চাঁদা দিতে দিতেই সব শেষ। যে কয় টাকা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাই। এখন শুনছি, সব উচ্ছেদ করে দেবে প্রশাসন। তাহলে আমরা কোথায় যাবো।
চাঁদা দিয়ে দোকান বসানোর কোনও সুযোগ নেই উল্লেখ করে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যারা চাঁদা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন, তারা সত্য বলেননি। কারা চাঁদা তুলছে আমরা খোঁজখবর নেবো। সেন্টমার্টিন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কিছু সিদ্ধান্ত আছে। সেগুলো বাস্তবায়নে একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কাজ করবো। সৈকতে অবৈধ দোকানপাট থাকবে না। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সব দোকানপাট উচ্ছেদ করবো।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: