সেতুর অভাবে ৫০ হাজার মানুষের ভোগান্তি
বাঁশ-কাঠের তৈরি একটি ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো দিয়ে দুই জেলার তিন ইউনিয়নের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কপোতাক্ষ নদ পার হয়। বছরের পর বছর ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করলেও সেখানে সেতু নির্মাণ করা হয়নি।
প্রথম নিউজ, যশোর: বাঁশ-কাঠের তৈরি একটি ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো দিয়ে দুই জেলার তিন ইউনিয়নের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কপোতাক্ষ নদ পার হয়। বছরের পর বছর ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করলেও সেখানে সেতু নির্মাণ করা হয়নি।
এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, যশোরের কেশবপুর উপজেলার ত্রিমোহিনী, মণিরামপুর উপজেলার মশ্মিনগর আর সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ এই সাঁকো দিয়ে চলাচল করে। বছরের পর বছর একটি সেতুর দাবি করলেও আজ পর্যন্ত আশ্বাসই জুটেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
তবে যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ওই স্থানে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, কেশবপুরের ত্রিমোহিনী ও কলারোয়ার দেয়াড়া ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। দুই ইউনিয়নকে যুক্ত করেছে ২৮০ ফুট দীর্ঘ সাঁকোটি। ত্রিমোহিনী ইউনিয়নের এই বাজারে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয় ও ডিগ্রি মাদ্রাসা। তাছাড়া বাজারটি বেশ পুরনো এবং অনেক বড়। দুই পাশের মানুষের রয়েছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। রয়েছে তিনটি ব্যাংকের শাখা। ত্রিমোহিনী লাগোয়া মশ্মিনগর ইউনিয়ন।
স্থানীয়রা জানান, দেয়াড়া ইউনিয়নের খোর্দো, চাকলা, নতুনবাজার, কাশিয়াডাঙ্গা ও বেলতলা এলাকা থেকে প্রতিদিন শাকসবজি, চাল ও কাঠসহ নানা জিনিসপত্র ত্রিমোহিনী বাজারে আনা হয়। ওসব এলাকার ছেলেমেয়ে ত্রিমোহিনীতে পড়াশোনা করে। অনেকে এই পথ ব্যবহার করে কেশবপুর ও মণিরামপুরের নানা শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করেন। ওই এলাকার রোগীরাও আসেন এই অঞ্চলে।
চার বছর আগে সাতবাড়িয়া গ্রামের পরিমন নামে এক নারী বাবারবাড়ি যাওয়ার সময় সাঁকো থেকে পড়ে যান। এতে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। এখনও তিনি সুস্থ হননি। বছরখানেক আগে সাঁকোর তক্তা ভেঙে নিচে পড়েন বাবু নামে দেয়াড়া এলাকার এক যুবক। পা ভেঙে এখন পঙ্গু তিনি। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। ছয় দিন আগে এক যুবক মোটরসাইকেলসহ পড়ে যান। সম্প্রতি একটি রিকশাভ্যান উল্টে গেছে নদে পড়ে যায়।
ত্রিমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী জিনিয়া সুলতানা মিম জানায়, এই সাঁকো পার হতে তাদের অনেক ভয় হয়। এতে ব্যবহৃত তক্তার বেশ কয়েক জায়গায় ভাঙা, নিচে নদের অংশ দেখা যায়। স্কুলে যাওয়া-আসার সময় অনেকে পা পিছলে পড়ে গেছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে একটু বেশি ভয় লাগে। একটা সেতু হলে আমাদের চলাচলে সুবিধা হতো।
দেয়াড়া এলাকার গৃহবধূ রেবেকা খাতুন বলেন, ‘প্রায়ই অকেজো হয়ে পড়েছে সাঁকোটি। লোকজনের কাছ থেকে টাকা তুলে মেরামত করে আবার চলাচলের উপযোগী করা হয়। সাঁকো দিয়ে চলাচল করতে সবারই ভয় লাগে, এই বুঝি ভেঙে পড়লো। একটা সেতু হলে নিরাপদে চলাচল করতে পারতাম।’
একই এলাকার ব্যবসায়ী পলাশ খান বলেন, ‘ব্যবসার কারণে প্রতিদিন কমপক্ষে চারবার সাঁকো ব্যবহার করতে হয়। ঘুরে আসতে হলে দূরত্ব প্রায় চারগুণ বেড়ে যায়। মালামাল পরিবহনে তখন অনেক বেশি খরচ পড়ে। চাঁদড়া এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী ফাজেল সানা বলেন, ‘আমি কলারোয়া উপজেলার খোর্দো, কাশিয়াডাঙ্গা ও নতুন বাজার এলাকা থেকে গাছ কিনি। সেগুলো ত্রিমোহিনী বাজারে আনতে প্রায় ২০ কিলোমিটার ঘুরতে হয়। এই পথে আনা গেলে দূরত্ব দুই-তিন কিলোমিটার কমতো। খরচও বাঁচতো।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ১৭ বছর আগে কপোতাক্ষ নদের ওপরে সাঁকো নির্মাণ করেন স্থানীয় বাসিন্দা শেখ লিয়াকত আলী। নিজের জমি বিক্রি করে এবং দুই পারের লোকজনকে এক করে নৌকা পারাপারের দিন শেষ করেন তিনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলার সময় সাঁকোটি পার হয়ে আসতে দেখা যায় লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিহিত বয়স্ক এক ব্যক্তিকে। এ সময় আশপাশের লোকজন বলতে থাকেন, ওই যে জমিদার সাহেব আসছেন। কিছুটা কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকালে অন্যরা পরিচয় করিয়ে দেন, উনি শেখ লিয়াকত আলী। এই অঞ্চলের মানুষ তাকে ‘জমিদার’ বলেই ডাকেন।
আলাপকালে শেখ লিয়াকত আলী বলেন, ‘২০ বছর আগেও এই নদ পারাপারে নৌকা ব্যবহার করা হতো। সে সময় প্রায়ই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটতো। দেখতাম, নৌকা ডুবে শিক্ষার্থীরা ভিজে একাকার; তাদের বই-খাতা নষ্ট হতো। সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হতো না। এমন ঘটনা অহরহ ঘটতো। কৃষক শাকসবজি নিয়ে বাজারে আসার পথে, কিংবা সার-কীটনাশক নিয়ে ফেরার পথে এমন ঘটনা ঘটতো। এসব দেখে কেটে গেছে কয়েক বছর।’
তিনি বলেন, ‘১৭ বছর আগে এই নদে নৌকা ডুবে আমার পরিবারে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। সেদিন পানিতে ডুবে আমার মামিসহ তিন জন মারা যান। বিষয়টি আমার হৃদয়ে দাগ কাটে। আমি দুই পারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে একটি সাঁকো বানানোর সিদ্ধান্ত নিই। বিক্রি করে দিই ১৭ শতাংশ জমি, ফান্ডে দিই ৭৩ হাজার টাকা। এরপর প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় সাঁকোটি। বাকি টাকা দুই পারের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ দিয়েছেন।’
ত্রিমোহিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। ত্রিমোহিনী বাজার বেশ বড় এবং এখানে রয়েছে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাশের উপজেলা কলারোয়ার দেয়াড়া ইউনিয়নের বেশিরভাগ লোকজন এই বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসেন। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে এখানকার স্কুলে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াত। সবচেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বর্ষাকালে। প্রতি বছর সাঁকোটি মেরামত করা লাগে, এতে দুই-তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাদের সেতু তৈরি করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি।’
কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য সদয় হলে এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব সম্ভব। ওনার সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার সেতুর বিষয়ে কথা হয়েছে, উনি বলেছেন করে দেবেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় তিন বছর পার হতে চললো। কিন্তু এখনও সেতুর বিষয়ে কোনও অগ্রগতি দেখলাম না।’
মণিরামপুর উপজেলার মশ্মিমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদের ওপর নির্মিত সাঁকোটি কলারোয়ার দেয়াড়া, কেশবপুরের ত্রিমোহিনী এবং মণিরামপুর উপজেলার মশ্মিনগর ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ ব্যবহার করে। ওখানে একটি সেতু নির্মাণ করা গেলে এ অঞ্চলের মানুষের সেতুবন্ধন রচিত হবে। এই অঞ্চলের মানুষ যশোর-খুলনা হয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানীতে নিয়ে যেতে পারবে। মানুষের চলাচল সহজ হবে। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার এ বিষয়ে আমার আলাপ হয়েছে, তিনি সেতু করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদের ওপরে একটি সেতু নির্মাণের বিষয়ে ইতোমধ্যে ডিও লেটার দিয়েছি। সুবিধামতো স্থানে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। তবে সাঁকোর ওই স্থানে নাকি আশপাশে সেতু হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews