শোলাকিয়া জনসমুদ্র, পাঁচ লক্ষাধিক মুসল্লির নামাজ আদায়
জামাত শুরু হওয়ার অন্তত দুই ঘন্টা আগে সকাল ৮টার মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক এই ঈদগাহ ময়দান। রোদের তেজ একটু একটু করে বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে মুসল্লিদের দীর্ঘ সারি।
প্রথম নিউজ, কিশোরগঞ্জ: চাঁদরাতে আকাশে ছিল গুমোটভাব। কিন্তু শনিবার (২২ এপ্রিল) ঈদুল ফিতরের দিন ভোরের সূর্যটা হেসে ওঠে শোলাকিয়ার আকাশে। আর এই মিষ্টি রোদ মাথায় নিয়ে শোলাকিয়া অভিমুখে ঢল নামে মুসল্লিদের। জামাত শুরু হওয়ার অন্তত দুই ঘন্টা আগে সকাল ৮টার মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক এই ঈদগাহ ময়দান। রোদের তেজ একটু একটু করে বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে মুসল্লিদের দীর্ঘ সারি। সকাল ১০টায় যখন শোলাকিয়ায় এবারের ১৯৬তম জামাত শুরু হয়, তখন জনসমুদ্র ছাড়িয়ে গেছে আশপাশের সড়ক ও অলিগলিসহ আবাসিক এলাকা। লাখো কণ্ঠের আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে শোলাকিয়া ঈদগাহ এলাকা। পাঁচ লক্ষাধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে এবার কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিবারের মতো এবারও শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতে অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে আসেন। দেশের সর্ববৃহৎ এ জামাতে অংশগ্রহণ করতে সকাল থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহের উদ্দেশ্যে। জায়নামাজ হাতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য দিয়ে মুসল্লিরা সমবেত হন শোলাকিয়া ঈদগাহে।
জামাত শুরুর অন্তত দুই ঘন্টা আগেই সাত একর আয়তনের শোলাকিয়া মাঠ পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে আসা দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসল্লির ভিড়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয় শোলাকিয়া ময়দান। আগত মুসল্লিদের অনেকে মাঠে জায়গা না পেয়ে পার্শ্ববতী রাস্তা, তিনপাশের ফাঁকা জায়গা, নদীর পাড় ও শোলাকিয়া সেতুতে জায়গা করে নিয়ে জামাতের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন। সকাল ১০টায় পাঁচ লক্ষাধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে জামাত শুরু হওয়ার আগে রেওয়াজ অনুযায়ী ১৫, ৫ ও ১ মিনিট আগে শটগানের ফাঁকা গুলির আওয়াজ করে নামাজের প্রস্তুতির সংকেত দেওয়া হয়। এবারের ১৯৬তম ঈদুল ফিতরের জামাতে ইমামতি করেন শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইমাম ইসলাহুল মুসলিহীন পরিষদের চেয়ারম্যান মাও. ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ। জামাত শেষে ইমাম তাঁর বয়ানে দেশ ও জাতির উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং মুসলিম উম্মাহর সংহতি ও ঐক্য কামনা করেন। এছাড়া দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা, পাপ থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর রহমত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন তিনি। প্রখর রোদে ঘামে ভেজা লাখো মুসল্লির উচ্চকিত হাত আর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আমীন, আমীন ধ্বনিতে এ সময় মুখরিত হয়ে উঠে পুরো ঈদগাহ এলাকা।
১৮২৮ সালে অনুষ্ঠিত ঈদের প্রথম বড় জামাতের হিসাব অনুযায়ী শোলাকিয়া ময়দানে এবার ছিল ১৯৬তম ঈদ জামাত। জামাতকে কেন্দ্র করে এবার নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মাঠে স্থাপন করা হয় ৬টি ওয়াচ টাওয়ার। ৭০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয় ঈদগাহ ময়দান, আশেপাশের এলাকা এবং অলিগলিসহ মাঠ সংলগ্ন চারপাশ। পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় এবারো যুক্ত ছিল ড্রোন। বিজিবি, শতাধিক র্যাব এবং পুলিশের ১২০০ সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেড় হাজারের মতো সদস্য দিয়ে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয় শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানকে। ঈদগাহ ময়দানের প্রবেশপথে স্থাপিত আর্চওয়ে দিয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হয় ঈদগাহ ময়দানে। এর আগে আরো অন্তত কয়েক দফা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মুসল্লিদের দেহ তল্লাসি করা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে মুসল্লিদের শুধু জায়নামাজ নিয়ে ঈদগাহে ঢুকতে দেয়া হয়।
মাঠের সুনাম ও জনশ্রুতির কারণে ঈদের বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সারাদেশের বিভিন্ন জেলা তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, শেরপুর, যশোর, খুলনা ও চট্রগ্রামসহ অধিকাংশ জেলা থেকে শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। এদের অনেকে ওঠেন হোটেলে, কেউবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আবার অনেকেই কোথাও জায়গা না পেয়ে রাত কাটান জেলা সদরের বিভিন্ন মসজিদে। ঈদের দিন শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে চলাচল করেছে ২টি স্পেশাল ট্রেন। একটি ট্রেন ভৈরব থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে আসে এবং অন্যটি ময়মনসিংহ থেকে সকাল পৌনে ৬টায় ছেড়ে আসে।
ঈদ জামাত শুরুর আগে ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ পিপিএম (বার) ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ মুসল্লিদের স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
জনশ্রুতি রয়েছে যে, ১৮২৮ সালে প্রথম বড় জামাতে এই মাঠে একসঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার অর্থাৎ সোয়ালাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করেন। এই সোয়ালাখ থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়ালাখিয়া’, যা উচ্চারণ বিবর্তনে হয়েছে শোলাকিয়া। শত ব্যস্ততা, নানা সমস্যা আর প্রাকৃতিক বৈরিতাকে উপেক্ষা করে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ধনী-গরীব সকলে নামাজ আদায় করেন শোলাকিয়া ঈদ জামাতে। তাঁদের সবার উদ্দেশ্য একটাই যেন কোন অবস্থাতেই হাত ছাড়া হয়ে না যায় জামাতে অংশগ্রহণ, পাপ থেকে মুক্তি আর আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ। ধনী-গরীবের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাম্য ও সুন্দরের ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ গড়ার এই শিক্ষা নিয়েই জামাত শেষে বাড়ির পথে শোলকিয়া ছাড়েন তাঁরা।