মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর মুদ্রানীতি
গতকাল বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গত জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ওই মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সেইভাবে মুদ্রানীতি সাজিয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার না কমে উল্টো আরও বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে। গত ৬ মাসে খাদ্যপণ্যেও দাম বেশি বাড়ায় এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এ ছাড়া মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় সুদের হার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। মুদ্রানীতি এই একটি খাতে সফল। সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা ঋণ নেয়া কমিয়ে দিয়েছে।
এতে টাকার প্রবাহ কমেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। বলা হয়েছিল সুদের হার বাড়লে টাকার প্রবাহ কমবে। তখন মূল্যস্ফীতিও কমে যাবে। কিন্তু সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত জুন মাসে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৭২ শতাংশ। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৯ শতাংশ। জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০.৪২ শতাংশ। গতকাল বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিবিএসের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৬, ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯.৬৭, মার্চে ছিল ৯.৮১ ও এপ্রিলে ছিল ৯.৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৬ মাসে ৯ শতাংশের উপরেই ছিল।
এদিকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতির এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সূত্র জানায়, চলতি মাসের শেষ দিকে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি টাকার প্রবাহ কমিয়েও মূল্যস্ফীতির হারে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি সংস্থাটি। রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করাও সম্ভব হয়নি। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বেড়েছে। মুদ্রানীতির এমন প্রধান ১১টি লক্ষ্যের মধ্যে মাত্র ২টির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। বাকি ৯টির লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি। তবে বিদায়ী অর্থবছরের মতো এবারো মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯.৭ শতাংশ। মে পর্যন্ত সাময়িক হিসাবে বেড়েছে ৩.১৬ শতাংশ। টাকার প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কমিয়েও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ওই সময়ে রিজার্ভ তো বাড়েনি। উলটো পতন হয়েছে। জুনের শেষে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৭ কোটি ডলার। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৭৭ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক ব্যালেন্সে ঘাটতি গত জুনের মধ্যে ৬০ কোটি ডলারের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এপ্রিল পর্যন্ত এ ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। বড় জটিলতা দেখা দিয়েছে রপ্তানি আয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেশে না আসা রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ১৫০ কোটি ডলার। জুন পর্যন্ত রপ্তানি আয় বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ শতাংশ। ওই সময়ে রপ্তানি আয় বাড়েনি। বরং গড়ে কমেছে ০.৫০ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে সতর্কতামূলক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু বছর শেষে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ বেড়েছে ১০.৬৬ শতাংশ।
ডলার সংকটের কারণে আমদানি এখনো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে আমদানিনির্ভর শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত জুন পর্যন্ত আমদানি ৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এপ্রিল পর্যন্ত কমেছে ১৫.৪২ শতাংশ। আমদানি কমায় এ খাতের শিল্পে নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। আমদানিনির্ভর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ জুন পর্যন্ত ২৭.৮ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মে পর্যন্ত বেড়েছে মাত্র ৭.১৮ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ শতাংশ। মে পর্যন্ত বেড়েছে ৭.১৯ শতাংশ।
আমদানি ব্যয় কমিয়ে ও রপ্তানি আয় বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। গত জুনের মধ্যে তা কমিয়ে ১ হাজার ২০ কোটি ডলারে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এপ্রিল পর্যন্ত ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। তবে ঘাটতি আগের চেয়ে কমেছে।
সুদহার বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের চাপ সরকারের অনেক অর্জনই ম্লান হয়েছে। এতে চাপে রয়েছে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তাই এবারের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্যই থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
এদিকে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা ও জিডিপি ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই লক্ষ্য ঠিক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকও মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাল, ডাল, চিনি, আটা-ময়দা, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, ডিম, পিয়াজসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এগুলো কিনতেই স্বল্পআয়ের মানুষের আয়ের সিংহভাগ চলে যায়। সাধারণত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো সুদের হার বাড়ানো। কিন্তু সেটি করেও অর্থাৎ সুদহার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতি লাগাম ছাড়াই রয়ে গেছে; যে কারণে নিম্নআয়ের মানুষ এখন বেশ কষ্টে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সে ক্ষেত্রে ডলারের দাম এবং সুদের হার নির্ধারণে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। টাকাকে আরও দামি করে তোলা হতে পারে। এতে ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরে নীতি সুদের হার দুই দফা বাড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সরকারের ব্যাংক ঋণের সুদে। সুদহারের সীমা তুলে দেয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদে। প্রথম দফায় গত জানুয়ারিতে নীতি সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয় ও গত মে মাসে তা ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮.৫ শতাংশ করা হয়। এর ফলে ঋণের সুদের হার বেড়ে সাধারণত ঋণের চাহিদা কমে যায়। ফলে গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে ৯.৯০ শতাংশে নামে।
বিবিএসের হিসাব অনুসারে, গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯.৭২ শতাংশ হয়েছে। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৯ শতাংশ। একইসঙ্গে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও ৩ মাস ধরে তা ১০ শতাংশের বেশি আছে। জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০.৪২ শতাংশ। গতকাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে মূল্যস্ফীতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।
বিবিএসের হিসাব অনুসারে, জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৬, ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯.৬৭, মার্চে ৯.৮১, এপ্রিলে ছিল ৯.৭৪ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের কর; ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে মূল্যস্ফীতি। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে ভোগান্তিতে পড়েন। দুই বছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের যাপিত জীবনে।