মিলছে না বৈদেশিক ঋণ, ভাঙ্গা-কুয়াকাটা রেলপথ নির্মাণে অগ্রগতি নেই

এ রেলপথ নির্মাণে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৩২ হাজার ১৯৯ কোটি ৯৪ লাখ, বাকি টাকা দেশীয় অর্থায়নে প্রভিশন রাখা হয়েছে।

মিলছে না বৈদেশিক ঋণ, ভাঙ্গা-কুয়াকাটা রেলপথ নির্মাণে অগ্রগতি নেই

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন থেকে বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত ৩৬৯ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ রেলপথ নির্মাণে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৩২ হাজার ১৯৯ কোটি ৯৪ লাখ, বাকি টাকা দেশীয় অর্থায়নে প্রভিশন রাখা হয়েছে।

‘ভাঙ্গা জংশন (ফরিদপুর) থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ (বিজি) রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলাসহ মোট সাতটি জেলার ওপর দিয়ে দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। রেলপথ নির্মাণে সমীক্ষা ব্যয় ৪৯ কোটি টাকা। রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়েছে ২০২২ সালের জুনে। এরপর থেকেই বৈদেশিক ঋণের সন্ধান করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণের উৎস এখনো খুঁজে পায়নি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

রেলপথ নির্মাণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, আমরা ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করতে প্রকল্প নিয়েছি। প্রকল্পের প্রস্তাবনা এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পে বাস্তবায়ন ব্যয়ের বড় অংশ বৈদেশিক ঋণ। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ এখনো পায়নি।’ ‘ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রস্তাবনা এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পে বাস্তবায়ন ব্যয়ের বড় অংশ বৈদেশিক ঋণ। সেই বৈদেশিক ঋণ এখনো পায়নি।’— রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে সিঙ্গেল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হবে, তবে ডাবল লাইনের প্রভিশনও থাকবে। রেলপথটি নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একটা মাইলফলক সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতুর সঠিক সুফল মিলবে এ রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে।’

বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, দীর্ঘ রেলপথটি সরকারি অভ্যন্তরীণ বা সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্য রেলপথটি নির্মাণে বৈদেশিক অর্থায়ন থাকবে বেশি। শুধু ভূমি অধিগ্রহণ খাতে কিছু অংশ সরকারি অর্থ ব্যয় করা হবে। বাকি অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন অথবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ নেবে সরকার। এরই মধ্যে দুই উন্নয়ন সহযোগীকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে ঋণ চেয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে, ঋণ দেওয়ার বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীরা এখনো সাড়া দেয়নি বলে দাবি করেছে ইআরডি। এ বিষয়ে ইআরডির এডিবি অনুবিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) ফরিদ আজিজ বলেন, এডিবি ভাঙ্গা-কুয়াকাটা প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। এত বড় প্রকল্পে এডিবি ঋণ দিলে জানতাম।’

পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর পরে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ থেকে ইআরডি বরাবর চিঠি দেওয়া হয় ঋণের জন্য। কিন্তু এখনো বৈদেশিক ঋণের কোনো উৎস মেলেনি। ‘এডিবি ভাঙ্গা-কুয়াকাটা প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি জানা নেই। এত বড় প্রকল্পে এডিবি ঋণ দিলে জানতাম।’— ইআরডির এডিবি অনুবিভাগের প্রধান।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ভাঙ্গা জংশন (ফরিদপুর) থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ (বিজি) রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্পে ফান্ড সোর্সিংয়ের জন্য ইআরডি বরাবর চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনো ফান্ড পায়নি। তবে এখনো পায়রা বন্দর সেভাবে ডেভেলপ হয়নি। এখনই রেলপথ নির্মাণ করলে সেভাবে রিটার্নি মিলবে না। আমরা প্রকল্পটি নিয়ে ধীরগতিতে এগোচ্ছি। কাজটা এগিয়ে থাকুক। আর বৈদেশিক ঋণের বিষয়টিও সময় সাপেক্ষ।’

বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে সাত বছর। এর মধ্যে দেড় বছর ধরে টেন্ডারিং, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজ করা হবে। সাড়ে চার বছর ধরে প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। বাকি এক বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড ধরা হয়েছে।

প্রকল্পের মূল কাজ: রেললাইনের মোট দৈর্ঘ্য বা রুট লাইন হবে ২১৪ দশমিক ৯১ কিলোমিটার, এর মধ্যে মেইন লাইন ১৯০ দশমিক ১১ কিলোমিটার ও ব্র্যাঞ্চ লাইন ২৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। তবে ট্র্যাকের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩৬৯ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে মেইন লাইন ২১৪ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ও লুপ লাইন ১৫৪ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার। রেলপথে এমব্যাংকমেন্টের দৈর্ঘ্য হবে ১৬৮ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার। ৪৪০টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হবে, এর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর ও পর্যটন স্পট কুয়াকাটার সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা হবে। পায়রা বন্দর থেকে ট্রেনে কনটেইনার এবং পণ্য বহন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে বরিশাল বিভাগ, পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা থেকে নিরাপদে যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। নতুন এলাকায় নিরাপদ, আরামদায়ক, কম ব্যয়বহুল যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে। ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয় বাড়বে। পায়রা বন্দর, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় পণ্য এবং যাত্রীদের পরিবহন খরচ কমবে, যা স্থানীয় জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে। দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে।

‘প্রকল্পে ফান্ড সোর্সিংয়ের জন্য ইআরডি বরাবর চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো ফান্ড পায়নি। তবে এখনো পায়রা বন্দর সেভাবে ডেভেলপ হয়নি। এখনই রেলপথ নির্মাণ করলে সেভাবে রিটার্নি মিলবে না। আমরা প্রকল্পটি নিয়ে ধীরগতিতে এগোচ্ছি। বৈদেশিক ঋণের বিষয়টিও সময় সাপেক্ষ।’ — ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব। পুরো রেলপথে থাকবে ১৯টি নান্দনিক স্টেশন বিল্ডিং: পুরো রেললাইনে ১৯টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ করা হবে। স্থানগুলো হলো- ভাঙ্গা জংশন, বরইতলা, টেকেরহাট, মাদারীপুর, কালকিনি, গৌরনদী, উজিরপুর, বরিশাল এয়ারপোর্ট, বরিশাল, দপদপিয়া, বাকেরগঞ্জ, বদরপুর, পটুয়াখালী, কাকুয়া, আমতলী, পায়রা পোট, পায়রা পোর্ট ইয়ার্ড, লেমুপাড়া ও কুয়াকাটা। প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রম: প্রকল্পের আওতায় ৪৮৬টি ব্রিজ-কালভার্ট, ৪১ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ৩ কিলোমিটার বক্স আন্ডারপাস ও ১ দশমিক ৪২ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পটি গুরুত্ব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং দক্ষিণ অঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ এরই মধ্যে স্থাপিত হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেললাইন স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা টু ভাঙ্গা রেল যাতায়াত শুরু হয়েছে। ভাঙ্গা টু যশোর রেল প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। তবে বরিশাল বিভাগে রেললাইন নেই। ভাঙ্গা টু কুয়াকাটা রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে মাদারীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলা ঢাকা, খুলনা, যশোর, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ সম্ভব হবে। বর্তমানে এসব জেলার সঙ্গে যাতায়াতে সড়ক এবং নৌ-পরিবহনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌ দুর্ঘটনায় অনেক সময় মূল্যবান জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হচ্ছে। রেল যাতায়াত অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব। এছাড়া পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র ও রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। ফলে পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি যাত্রী পরিবহন থেকেও রাজস্ব আয় বাড়বে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে, যা জিডিপিতে অবদান রাখবে।