ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের পূর্ণতা আজও আসেনি: রণেশ মৈত্র
রণেশ মৈত্র বলেন, ঢাকার সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে পাবনাতে প্রথম ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তুমুল আন্দোলন হয়।
প্রথম নিউজ,পাবনা: একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক রণেশ মৈত্র। ১৯৩৩ সালে ৪ অক্টোবর রাজশাহীর নওহাটায় জন্ম নেওয়া এই ভাষাসৈনিকের পৈত্রিক নিবাস পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়ীয়া। ১৯৫০ সালে চাকরিতে থাকাকালেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ নানা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলনের সূত্র ধরে শরিক হন ভাষা আন্দোলনে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এক সংগ্রামী মানুষ। বয়স ভর করলেও লেখনীশক্তি এখনো তার কলমে সচল। আর মহান ভাষা আন্দোলনসহ বাঙালির সব অন্দোলন-সংগ্রাম তার স্মৃতিতে অম্লান।
বর্ষীয়ান ভাষাসৈনিক রণেশ মৈত্রের বয়স এখন ৮৮ বছর। ভাষার মাসে কথা হয় সেই সময়ের আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে।আলাপকালে তিনি বলেন, দাবি ছিল মাতৃভাষা বাংলার। এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা ছিল। আজও আদালতের ভাষা বাংলা করা হয়নি। সাইনবোর্ডগুলো শুধু বদলেছে মাত্র। ইংরেজি শিক্ষার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়ে গেছে। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ধনাঢ্য ব্যক্তির সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পাঠ শেষে দেশান্তরী হচ্ছে আর বাংলা মাধ্যমে পড়ে গরিবের শিশুরা পড়ছে পিছিয়ে। বাংলা যেন আজও গরিবের। আমরা সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু বাংলার জন্য আবেগ সবচেয়ে বেশি।
রনেশ মৈত্র জানান, ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় যোগ দেন ভাষা অন্দোলনের মিছিলে। সেদিন অত কিছু না বুঝতে পারলেও জনতার যে ক্ষোভ এবং মাতৃভাষার মর্যাদার প্রশ্নে যে উন্মাদনা-সেটাতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেন তিনি। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন পাবনাতেও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। আর সেই সময়ে পাবনায় ভাষা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি।
কীভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়ান জানতে চাইলে রণেশ মৈত্র বলেন, ঢাকার সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে পাবনাতে প্রথম ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তুমুল আন্দোলন হয়। ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন পাবনায় গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বাদশা ও ঈশ্বরদীর মাহবুব আহমেদ খান। ১১ মার্চ ধর্মঘট ও আন্দোলনের ঘোষণা দিতেই জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। কিন্তু এ ধারা ভেঙে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ছাত্ররা শহর প্রদক্ষিণ করেন এবং আশপাশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সে মিছিলে যোগ দেন।
এই ভাষাসৈনিক জানান, তিনি তখন ঐতিহ্যবাহী গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউটের (জিসিআই) অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ওইদিন মিছিলে আরও যোগ দিয়েছিলেন আমজাদ হোসেন (পরবর্তী সময়ে এমএনএ), রওশন জান চৌধুরী, আব্দুর রব বগা মিয়া প্রমুখ। মিছিল শেষ হতে না হতেই আমিনুল ইসলাম বাদশাসহ ১০ থেকে ১২ জন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
রণেশ মৈত্র বলেন, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনরত ভাষাসৈনিকদের ওপর যে গুলি চালানো হয়, তার খবর ইন্ডিয়া রেডিওতে পাই। পাকিস্তান রেডিও তা প্রচার করেনি। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রেডিওতে খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আব্দুল মমিন তালুকদার নামে ছাত্রলীগের এক নেতা (যিনি সে সময় এডওয়ার্ড কলেজের জিএস ছিলেন), তাকেসহ অন্য নেতাদের নিয়ে শিখা সংঘের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা ঢাকায় গুলি চালানোর প্রতিবাদে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পাবনায় হরতাল পালন করবো। আর সেই হরতালের খবর আমরা টিনের চোঙা দিয়ে প্রচার করলাম। তখন পাবনা শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে। ১৪৪ ধারা চলছে। তার মধ্যে আমরা এক মোড় থেকে দৌড়ে আরেক মোড়ে গিয়ে হরতালের খবর বলি। এভাবে কয়েকটি ব্যাচে ভাগ হয়ে আমরা হরতালের খবর প্রচার করি।
ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা অমান্য করে পুরো শহরে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করে। সেদিন পাবনায় পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। এদিকে, ভাষা আন্দোলনের ব্যাপ্তির কারণে পাবনায় ভীতসন্ত্রস্ত মুসলিম লীগ কোনো জনসভা বা কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। কিন্তু নির্বাচন এসে যাওয়ায় তারা পাবনা স্টেডিয়ামে প্রাদেশিক সম্মেলন আহ্বান করে। জনসভারও আয়োজন করা হয়। ওই জনসভায় নুরুল আমিনকে ভাষণ দিতে না দেওয়ার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও বিড়ি শ্রমিক নেতারা বিশাল মিছিল নিয়ে অগ্রসর হন সভার দিকে। এসময় মুসলিম লীগের গুণ্ডারা সে মিছিলে আক্রমণ চালালে ৫-৬ জন ছাত্রনেতা আহত হন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আবারও মিছিল নিয়ে স্টেডিয়ামে যান এবং শামিয়ানা, চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে ঢিল ছুড়ে মুসলিম লীগের সভা পণ্ড করে দেন। সেটি ছিল ছাত্র-জনতার ভাষার বিজয়ের ধারাবাহিকতায় আরেকটি বিজয়। জানান এই ভাষাসৈনিক।
রণেশ মৈত্র বলেন, পরবর্তীসময়ে আমরা গ্রামে গ্রামে, সব স্কুলে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি ছাত্রদের নিয়ে। আর তাতে সরকার ছাড়া শিক্ষক, ছাত্রসহ সবার ব্যাপক সমর্থন ছিল। এ আন্দোলনটা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে পাবনায় ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল মোমিন তালুকদার। তাদের সঙ্গে যৌথভাবে ভাষা আন্দোলন করেন।’
স্মৃতি হাতড়ে ভাষাসৈনিক রণেশ মৈত্র বলেন, বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যে কয়েকটি জেলায় ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জন-অংশগ্রহণে জোরালো আন্দোলন হয়েছিল পাবনায়। আক্ষেপ করে বলেন, ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন আমরা শুধু শ্রদ্ধা জানাই ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। আমরা শহীদ মিনারে যাই, ফুল দেই, প্রার্থনা করি। এটাই সব নয়। এখনো অনেক কাজ বাকি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অনেক কাজ করার আছে। আমরা বাংলায় ছেলেমেয়েদের নাম রাখি কম। এটা ভাবা দরকার। বাংলাদেশকে যত উন্নত করবো বাংলা ভাষা আন্দোলন তত সফল হবে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, যে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে, ভাষাসৈনিকদের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, সেই ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা আজ পর্যন্ত কোনো সরকার করেনি। আমরা দেখি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, কিন্তু ভাষাসংগ্রামীদের কোনো তালিকা দেখি না। ‘মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে ভাষাসৈনিকরা বয়সে অনেক বড়। যারা বেঁচে আছেন, অনেকে বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাদের জন্য কোনো ভাতার ব্যবস্থা করেনি কোনো সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যেটা করা হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, অবিলম্বে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রণয়ন ও ভাতার ব্যবস্থা চালু করা হোক। ভাষাসৈনিকদের ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষাব্যবস্থা চালুসহ তাদের শিক্ষাভাতার ব্যবস্থা চালু হোক। এছাড়া যেসব ভাষাসৈনিক গৃহহীন, তাদের সরকারিভাবে উপযুক্ত বাসগৃহের ব্যবস্থা এবং বৃদ্ধকালে যাতে তারা সংসার চালাতে পারেন সেজন্য মাসিক ভাতা বাধ্যতামূলক করা হোক।
ভাষা আন্দোলনের মূল কথা ছিল সমৃদ্ধ এবং শোষণমুক্ত বাংলাদেশ। রণেশ মৈত্র মনে করেন, বাঙালি কোনো ছেলেমেয়ে যাতে বেকার না থাকে, অশিক্ষিত না থাকে, সবাই যাতে সুখী সমৃদ্ধ হয়, শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠে, সারা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- সেটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: