প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরেও বিপাকে চীন
প্রথম নিউজ, ডেস্ক : গত বছরের শেষ তিন মাসে চীনের অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাতে ২০২৪ সালের ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে দেশটির সরকার। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও চীনের এই প্রবৃদ্ধির হার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
আবাসন বাজারের দীর্ঘস্থায়ী মন্দা, সরকারের বিপুল ঋণ এবং বেকারত্ব কাটিয়ে উঠতে রীতিমত লড়াই করছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি। গত বছরের শেষের দিকে অর্থনীতির গতি বাড়াতে বেশ কয়েকটি প্রণোদনা ব্যবস্থা চালু করে বেইজিং। দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান ই কং বলেছেন, ২০২৪ সালে যে অর্থনৈতিক সাফল্য এসেছে তা অনেক কষ্টের ফলে অর্জিত হয়েছে।
অতীতেও দেখা গেছে, চীন নিজেদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে খুব কমই ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরাও প্রবৃদ্ধির একই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকও এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ঋণ নেওয়ার খরচ কমে যাওয়া এবং রপ্তানি বাড়ার কারণে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হবে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের যে শুল্ক আরোপের হুমকি সেটাকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। এরই মধ্যে তারা নিজেদের প্রস্তুতিও শুরু করেছেন। তবে চীনের পরবর্তী বছরের প্রবৃদ্ধির অর্জনের পথে এই শুল্কই কেবল বাধা নয়। চীনের সামনে আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
শুল্কের কারণে চীনের রপ্তানি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চীন মন্দা এড়াতে শিল্পখাতে নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। দেশটি রেকর্ড সংখ্যক বৈদ্যুতিক বাহন, থ্রিডি প্রিন্টার এবং শিল্প রোবট রপ্তানি করছে। চীনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত পণ্য তৈরির অভিযোগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা দেশীয় কর্মসংস্থান ও ব্যবসা রক্ষার জন্য চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা রপ্তানিকারকরা এখন বিশ্বের অন্যান্য অংশে মনোনিবেশ করতে পারেন। তবে সেই দেশগুলো বেইজিংয়ের জন্য হতে পারে উদীয়মান বাজার যাদের উত্তর আমেরিকা কিংবা ইউরোপের মত অত চাহিদা নেই।
ফলে চীনা ব্যবসায় প্রভাব পড়তে পারে। জ্বালানি ও কাঁচামাল সরবরাহকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শি জিনপিং চাচ্ছেন২০৩৫ সালের মধ্যে চীনকে বিশ্বের সস্তা পণ্যের কারখানা থেকে একটি উচ্চ প্রযুক্তির শক্তিতে রূপান্তর করতে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শুল্কের মুখে কীভাবে উৎপাদন খাত এত বড় প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হতে পারে তা স্পষ্ট নয়।
চীনের সাধারণ মানুষ আগের মতো খরচও করছে না। বেইজিং আবাসন বাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য বেশ কয়েকটি নীতি বাস্তবায়ন করেছে। দেশটির আর্থিক বাজারের নজরদারি সংস্থা চায়না সিকিউরিটিজ রেগুলেটরি কমিশন (সিএসআরসি) বলছে, তারা সংস্কারকে জোরালোভাবে সমর্থন করবে।
কিন্তু এখনও অনেক বাড়ি এবং বাণিজ্যিক সম্পত্তি খালি পড়ে আছে। চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত সরবরাহ থাকায় এসবের দাম কমছে। চলতি বছর আবাসন বাজারের মন্দা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকিং জায়ান্ট গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, এই মন্দা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর বহু বছরের টানাপড়েনের ফল হিসেবে কাজ করবে।
দেশের ভেতরে ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় নতুন গাড়ি, বিলাসবহুল পণ্য এবং প্রায় সব কিছু রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনীতির ক্ষতি পূরণ করতে চায় দেশটি। সরকার ভোগ্যপণ্য ট্রেড-ইনের মতো কর্মসূচিও চালু করেছে, যেখানে মানুষ তাদের ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ এবং রাইস কুকার বিনিময় করতে পারবে।
তবে অর্থনীতির সংকটগুলো সমাধান না করে কেবল নানা ধরনের পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে পারবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোগব্যয় আগের জায়গায় ফেরাতে কোভিড মহামারীর আগের সময়ের চাইতে মানুষের পকেটে বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে।
কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, মহামারীর আগের তুলনায় বেকারত্বের হার বেড়েছে এবং মজুরি বৃদ্ধি থমকে রয়েছে। আগের মত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চীনে আসছে না। এছাড়া শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে চীনে বিনিয়োগের আগ্রহ হারাচ্ছেন বিদেশি ব্যবসায়ীরা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনীতিকে সহায়তার জন্য চীন সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কেবল সম্ভাব্য নতুন মার্কিন শুল্কের প্রভাবকে আংশিকভাবে ঠেকাতে সক্ষম হবে। গোল্ডম্যান স্যাকসের চীন বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হুই শান সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, বেইজিংকে হয় বড়, সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে অথবা মেনে নিতে হবে যে অর্থনীতি আর দ্রুত গতিতে বাড়বে না। আমরা আশা করি, তারা প্রথমটি বেছে নেবে।