‘প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে’
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি লেভেলে চেষ্টা করা হবে নিশ্চিত করতে কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীসহ কোনো ব্যক্তি যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বলেছেন, আমরা নিশ্চিত করতে চাই, সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমাদের আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচারী হয়ে যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন বা পারবেন না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি লেভেলে চেষ্টা করা হবে নিশ্চিত করতে কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে আমরা দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মতামতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাই। আমরা মানবাধিকার, মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ্। গতকাল রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপি’র উদ্যোগে ‘৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’- শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সেমিনার শুরু হয়। প্রথমে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের রূপরেখার পটভূমি তুলে ধরেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ। এরপর দলের তৈরি একটি পাওয়ার পয়েন্ট দুই পর্বে প্রদর্শন করা হয়। প্রথম পর্ব প্রদর্শন করেন ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল এবং দ্বিতীয় পর্ব প্রদর্শন করেন ড. মাহাদী আমিন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, নরওয়ে, পাকিস্তানসহ ৩৮ দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে নাগরিক ও রাজনীতিবিদরা বলেন, ৩১ দফার প্রতিটি ধারার পক্ষে এবং বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার। এজন্য প্রত্যেকটি দফাকেন্দ্রিক তর্ক জারি রাখা দরকার। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার এই দফাতে সম্পৃক্ত হওয়া দরকার। বর্তমানে দেশে আলোচিত প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবই বিএনপি’র ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারেক রহমান। বলেন, আমি সংস্কারের উদ্দেশ্য বলতে সেটিই বুঝি, যে সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্য নয়, বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি, যা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিটি নারী ও পুরুষের বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করবে। যে সংস্কার নারীদের সম্মান, স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে। যে সংস্কার সকল মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। যে সংস্কার দেশের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠন করবে। যে সংস্কার মানুষকে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দেবে। যে সংস্কার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখবে। আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি, যা কৃষক, শ্রমিক এবং সকল কর্মজীবী মানুষের ন্যায্য ও প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত করবে।
তিনি বলেন, আজকে আমরা যারা এখানে উপস্থিত রয়েছি, আমাদের রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা আছে, সেটিই স্বাভাবিক। তবে আমি বিশ্বাস করি, ভিন্ন-ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার মাঝেও বৃহত্তর পরিসরে আমাদের সবার মাঝে একটি বিষয়ে আদর্শিক ঐকমত্য রয়েছে। আর সেই বিষয়টি হলো, একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। আমরা সবাই এমন দেশ গড়তে চাই, যেখানে আর কখনো ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না। আমরা সবাই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ চাই, যেখানে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নেবে না। আমরা সবাই একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত বাংলাদেশ চাই, যেখানে গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে, নির্বাচিত ও জবাবদিহিমূলক সরকার নিশ্চিত করবে জনগণের মালিকানা ও অংশীদারিত্ব।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের সময় আমরা তথাকথিত উন্নয়নের রাজনীতি দেখেছি উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, পতিত সেই রাজনীতির ভিত্তি ছিল দুর্নীতি, দুঃশাসন ও দুর্বৃত্তায়ন। অন্যদিকে জনগণের ভোটে বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, আপনারা দেখতে পাবেন, আমাদের ৩১ দফার আলোকে, জনগণের ক্ষমতায়ন ও অংশীদারিত্বের রাজনীতি। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হবে আইনের অনুশাসন, মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা। আমরা যদি একটি রুলস-বেজড রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে আসতে পারি, সারা পৃথিবী থেকে প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট ও প্রাইভেট ক্যাপিটাল নিজ গতিতেই বাংলাদেশে আসবে।
আমাদের পাবলিক সেক্টরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে, দেশের উন্নয়ন ও উৎপাদনে ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে, আমরা দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে চাই। ঠিক যেভাবে আজ থেকে দুই দশক আগে, বিএনপি সরকারের সময়, বাংলাদেশে মিডিয়া নির্ভয়ে সরকারের সমালোচনা করতে পারতো, কার্টুন আঁকতে পারতো। আপনাদের নিশ্চই মনে আছে, আমাকে নিয়ে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে, মিডিয়ার একাংশ ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করেছিল, মিডিয়া ট্রায়াল ও প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইন করেছিল। কিন্তু আমরা তার প্রতিদানে কোনো মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করিনি, কাউকে হেনস্থা করিনি, কোনো সম্পাদককে জেলে পাঠাইনি। গত ১৬ বছরে আমার নিজের, আমার দলের এবং গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি তথা আপনাদের অনেকের ফ্রিডম অফ স্পিচ, ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন এবং ফ্রিডম অফ এসোসিয়েশন সম্পূর্ণভাবে হরণ করা হয়েছে। সেই উপলব্ধিকে ধারণ করে, আমরা সকল নাগরিক, বিশেষত মানবাধিকারকর্মী, সংবাদকর্মী, ও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবো, ইনশাআল্লাহ্।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের লক্ষ্য এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে ইউটিউব, ফেসবুক ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের ভাবনা প্রকাশের কারণে কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিষয়ে মন্তব্যের দায়ে, কাউকে হেনস্তা করা হবে না। সত্য গোপন করতে মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়া যেমন বাধ্য থাকবে না, তেমনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেটির প্রচারেও সরকার কাউকে চাপ দেবে না। তবে দেশ গঠনের দায়িত্ব সবার এবং আমরা মিডিয়ার কাছ থেকে নিরপেক্ষ এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করি।
তিনি বলেন, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, গুম, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা ও বিচার, পরোয়ানা ছাড়াই গণগ্রেপ্তার এবং চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে ভয়ের সংস্কৃতি গত ১৬ বছরে গড়ে উঠেছিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিএনপি সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে সেটি নির্মূল করার। জাতিসংঘ প্রণীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুসারে আমরা নিশ্চিতের চেষ্টা করবো প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে কেবল একটি দল থেকে অন্য দলের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর নয়। বরং ক্ষমতার পালাবদলে এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হওয়া উচিত, যেখানে সমাজের পরিবর্তিত অবস্থা ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়।
তারেক রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদের পতনের পর গত ৩ মাসে, বিএনপি’র জাতীয় নেতৃবৃন্দ এমন অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, যাতে রাজনীতিতে আধুনিকায়নের উন্মেষ ঘটে। সেইসব উদ্যোগকে, তারুণ্যের উদ্দীপনায়, দেশজুড়ে প্রতিপালন করেছে বিএনপি’র তৃণমূল। ফলে আপনারা দেখেছেন, অতীতের মতোই কীভাবে বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা বন্যার সময় সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি ও সাহায্য নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে, গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত পরিবারগুলোকে আন্তরিক সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করছে, জনদুর্ভোগ এড়াতে মোটরসাইকেল বহর বা শোভাযাত্রা থেকে নিজেদের বিরত রাখছে, রাজনৈতিক প্রোগ্রাম শেষে অত্র স্থান পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করছে, নগরের দেয়াল থেকে ব্যানার ও পোস্টার অপসারণ করছে, ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছে জনসম্পৃক্ত ও সমাজবান্ধব রাজনীতিকে।
তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদের দোসরদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে পূজার সময় বিএনপি’র নেতাকর্মীরা মন্দির ও উপাসনালয় পাহারা দিয়ে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সকল মানুষের সুরক্ষায় পাশে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম-বর্ণ, কিংবা ভৌগোলিক-আদর্শিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক যেন তার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অধিকার বিনা বাধায় উপভোগ করতে পারে সেই লক্ষ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন। সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই বিএনপি’র নীতি। জাতীয়তাবাদের আদর্শই বিএনপি’র রাজনীতি। আমরা বিশ্বাস করি ধর্ম, দল ও মত যার যার- তবে রাষ্ট্র সবার।
তারেক রহমান বলেন, আজ আমরা ৩১ দফার যে আলোচনা এখানে করেছি, তা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে আকাঙ্ক্ষার আলো দেখাবে পরিবর্তনকামী গণমানুষকে। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই রূপরেখা তৈরি হয়েছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০, বিএনপি’র জনসম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে প্রথমে প্রদত্ত ২৭ দফার ওপর ভিত্তি করে যা পরবর্তীতে যুগপৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যে ৩১ দফায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেটি নিশ্চিত করতে বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায়, যাতে কেউ পরপর দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারে। আমরা আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে চাই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজের জ্ঞানী-গুণীদের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য তরুণ ও বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান, আর কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যোগ্যতা অনুযায়ী বেকার ভাতা প্রবর্তন। আমরা নিশ্চিত করতে চাই সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ, তৃণমূলের ক্ষমতায়ন এবং আবারো ঐতিহাসিক খাল কাটা কর্মসূচির বাস্তবায়ন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, জ্বালানি, জলবায়ু, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে আনতে চাই যুগোপযোগী আমূল পরিবর্তন। যেন তৈরি হয় দক্ষ মানবসম্পদ, বৃদ্ধি পায় রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, স্থাপিত হয় মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, কৃষক ও উৎপাদনকারীদের জন্য ন্যায্য মূল্য, চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও বহুভাষার প্রশিক্ষণ, বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সবার জন্য পর্যায়ক্রমে আবাসন সুবিধা ও সামাজিক সুরক্ষা। এই পরিকল্পনাগুলো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠী- সমতল-পাহাড়ি নির্বিশেষে সুষম ও সমঅধিকারের আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে একটি ঐকমত্যের ভিশন বলেই আমি মনে করি। পরিবেশ, পরিস্থিতি, দেশের প্রয়োজন এবং মানুষের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে ৩১ দফাকে সংযোজন, বিয়োজন, পুনর্বিন্যাস বা পরিবর্তনও করা যেতে পারে। তবে তা হবে স্টেকহোল্ডার কন্সালটেশন তথা অংশীজন পরামর্শ ও জনমত ঐক্যের মাধ্যমে। সময়ের সঙ্গে এই ৩১ দফাই একদিন আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য তথা সুখী ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ অর্জনের দ্বার উন্মোচন করবে যা বিশ্ব মানচিত্রে পরিচিত হবে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিল্পায়নে সাফল্যমণ্ডিত, অর্থনীতিতে গতিশীল, মানবসম্পদে সমৃদ্ধ, এবং সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে।
তিনি বলেন, বিএনপি’র একজন কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কেবল ক্ষমতায়ন নয়। বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন এবং জনগণের অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশও এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজকে আমরা যারা এখানে সমবেত হয়েছি, দেশে-বিদেশে আমরা যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে সবসময় ভাবি, আমাদের গড়ে তুলতে হবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, উদার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমাদের সবাইকে এক হয়ে এগিয়ে যেতে হবে বহুদূরে। এই অগ্রযাত্রার গতি হতে হবে দ্রুত তবে স্থির, লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট। জাতীয় ঐতিহ্য ও অতীতের ভালো অর্জনগুলোকে ধারণ করে আমাদের চেতনা এবং দায়বদ্ধতাকে হতে হবে ভবিষ্যৎমুখী। গতানুগতিক ধারার রাষ্ট্র পরিচালনায় আবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমাদের উৎসাহ দিতে হবে আধুনিকতাকে, বরণ করে নিতে হবে অভিনবত্বকে। সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আলিঙ্গন করে নিতে হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের চিন্তাধারাকে, যা পরবর্তীতে পরিবর্তন করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেও।
তিনি বলেন, গত ১৬ বছর ধরে এবং জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষের প্রতিটি ব্যক্তি, দল, সংগঠন ও গোষ্ঠী তাদের সকলের আত্মত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিটি শ্রেণি-পেশা মতের মানুষের অংশগ্রহণকে সম্মান জানিয়ে লুণ্ঠিত ভোটাধিকার ফিরিয়ে এনে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে- একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের সমন্বিত অগ্রাধিকার।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দুই বছর আগে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য জাতির সামনে যে প্রস্তাব করেছিলাম, সেটা আবার আমরা নতুন প্রস্তাব করতে চাই। কারণ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের উদ্যোগে নেয়া হয়েছে। আমরা সেই বিষয়টি আবার জনগণের সামনে তুলে ধরছি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এই ৩১ দফাগুলোর সঙ্গে নতুন যে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো আসবে, তার সঙ্গে অনেকগুলো মিলে যাবে এবং মিলতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ এখন পলাতক। যারা ফ্যাসিস্ট সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন তাদের ভিতরেও আমি বিভেদ লক্ষ্যে করছি। আমরা কেনো দেশের মঙ্গলের জন্য এই সংঘাত এবং দ্বন্দ্বের উপরে উঠতে পারছি না। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংস্কারের শুরুও নাই এবং শেষও নাই। সব সময় সংস্কার চলবে। আর নতুন বাংলাদেশ চান তাহলে দেশে গণতন্ত্র লাগবে, সেজন্য ভোট লাগবে। এমন ভোট, যেটা সবাই গ্রহণ করবে। এজন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ লাগবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমি শুধু গতানুগতিক সরকার পরিবর্তন করতে চায়নি। এই দফাগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে একটা জাতীয় ঐক্যে এবং মানুষের সমর্থন আমরা লক্ষ্যে করেছি। আমাদের প্রশ্ন করে বিএনপি যে ৩১ দফা করেছে, আপনারা কী ভরসা রাখছেন। আমরা বলেছি, এবার আমরা ভরসা রাখতে চাই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি ৩১ দফা দিয়েছে, জামায়াত ১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে এবং অন্য দলগুলোও দিয়েছে। এই দফাগুলো বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বিএনপি যাতে ৩১ দফাতেই না থেকে যায়, প্রয়োজনে যাতে আমরা আরও কিছু সম্পৃক্ত করতে পারি।
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্যে রাখেন অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান, এডভোকেট এলিনা খান প্রমুখ। সেমিনারে সঞ্চালনা করেন শামা ওবায়েদ এবং এডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। এ ছাড়া এতে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদসহ দলটি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতীয় পার্টির মোস্তফা জামাল হায়দায়, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, এলডিপি’র রেদোয়ান আহমেদ, এনপিপি’র ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন যুগপৎ আন্দোলনের দল-জোট এবং নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের নেতৃবৃন্দরা।