নির্বাচন কবে, ‘নিশ্চয়তা’ দিচ্ছে না সরকার

প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে রাজনৈতিক দলে প্রতিক্রিয়া

নির্বাচন কবে, ‘নিশ্চয়তা’ দিচ্ছে না সরকার

প্রথম নিউজ, অনলাইন:   আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। বরং নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। ফলে নির্বাচন এ বছর হবে কি না, সেই সংশয় আরো ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচনের সময় নিয়ে সরকারের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর ‘আস্থাহীনতা’ও বাড়ছে।
 

সর্বশেষ গত ১৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে কিংবা আগামী বছরের জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে তারা যদি ‘বৃহত্ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে, তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে বৈঠককালে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে এ কথা বলেন।

ড. ইউনূসের এই বক্তব্যে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গত কিছুদিনে চলতি বছরের ডিসেম্বর, আগামী বছরের মার্চ ও জুন—এই তিনটি সময় ধরে নির্বাচনের যে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা—এসব বক্তব্যের মধ্যে কোনটি ঠিক, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।

রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অনেকে মনে করছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবকে কোনো কথা বলা মানে এর তাৎপর্য অনেক বেশি। তার মানে হচ্ছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে সরকারের মধ্যেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা আছে।
অথবা ডিসেম্বরে নির্বাচন না দেওয়ার জন্য তিনি এক ধরনের চাপে আছেন। তাই নির্বাচন কবে, সেই বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারছেন না প্রধান উপদেষ্টা। 

সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নির্বাচন ‘সম্ভব নয়’। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এখনো পুরোপুরি জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং এ বছর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে।

নাহিদের বক্তব্যের সপ্তাহ খানেক পর প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে এই বক্তব্য দিলেন।
দুজনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে অনেকে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাচ্ছেন। দুটি বক্তব্য ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও একই সূত্রে গাঁথা বলছেন তাঁরা। কেউ কেউ বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তা কিছু বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টত বুঝা যায়। 

নাহিদ ইসলামের বক্তব্য ধরে গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। ওই আলোচনায় আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয়ের কথা উঠে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর সেই আশঙ্কা আরো ঘনীভূত হলো। দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করেন, চলতি বছর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এখনো ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে। খোদ সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনের পর দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেছেন, ‘যত দিন না পর্যন্ত খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে দেখছি, তত দিন যেন কেউ ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে।’ এসব বক্তব্য নির্বাচন বিলম্ব করতে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। এখন দৃশ্যত সেই বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন তিনি। গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা বৈঠক শেষে বলেছিলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা আশ্বস্ত করেছেন, অতি দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছেন।’

গত ১০ মার্চ যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, এই বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরে কিংবা ২০২৬ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হবে। তবে সব সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। নির্বাচন নিয়ে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য আসা উচিত বলে মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। 

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির সর্বশেষ বৈঠকের বিষয় তুলে ধরে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ  বলেন, ড. ইউনসূ তাঁর বক্তব্য থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। তখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও এখন ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ হলে ডিসেম্বর আর ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ হলে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলছেন। এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন তা তাঁকে (ড. ইউনূস) পরিষ্কার করতে হবে।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আইনি সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার ও মাঠের সংস্কার করতে তিন মাসের বেশি সময় লাগে না। এর সঙ্গে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আসন পুনর্বিন্যাসসহ নির্বাচন কমিশনের কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ রয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।’ তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার তো নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে করতে হবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অন্য যেসব সংস্কার করা দরকার সেগুলো সময়সাপেক্ষ বিষয় নয়।

সরকারসংশ্লিষ্ট একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জানান, যেহেতু এটি নির্দলীয় সরকার, তাই কোনো দলের মতামতকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। ড. ইউনূস হয়তো ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করতে চান। তার পরও ডিসেম্বরে সম্ভব না হলে যাতে জুনের মধ্যে করা যায়, সেই সুযোগ হাতে রাখছেন তিনি। এর মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করতে চান। তবে নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি হলে মতানৈক্য প্রকট হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

অবশ্য বিএনপি জোটের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, সংস্কার পরিধি এক দলের কাছে এক রকম। অন্তর্বর্তী সরকারে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি আছেন। ফলে সরকারের ওপর তাঁদের প্রভাব রয়েছে, যার কারণে সরকারের মধ্যে নতুন দলের বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়। বড় দল হিসেবে বিএনপিকে সরকার যেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন আবার অন্য দলগুলোকেও নাখোশ করছে না। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ জন্য হয়তো নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে তাঁর বক্তব্যে সময়ে সময়ে পরিবর্তন আসে। তবে এটা ঠিক যে সরকার নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে ‘নিশ্চয়তা’ দিতে চাইছে না।

এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু  বলেন, ‘কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বর আর বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন। এটা সরকারের পিছু হটার লক্ষণ। প্রধান উপদেষ্টা কখনো বিএনপি কখনো বৈষম্যবিরোধীদের মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে নিজের অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলছেন। তাঁর কাছ থেকে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রূপরেখা আসা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূসের কথাবার্তায় কখনো কখনো মনে হচ্ছে তিনি দোদুল্যমানতায় আছেন। প্রথম দিন ঢাকায় নেমেই বললেন, তিনি আমাদের সহযোদ্ধা এবং তাঁর কথা আমাদের শুনতে হবে। আমরা এটাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলাম। তিনি যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো কোনো আপত্তি করেনি। সম্প্রতি তিনি বলতে শুরু করেছেন; তিনি আমাদের সহযোগী এবং আমরা যেভাবে চাই সেভাবে তিনি করবেন।’

অবশ্য ড. ইউনূসের বক্তব্যে কোনো বিভ্রান্তি দেখছেন না ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। তাই জুনেও যদি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হয় তাহলে আরো পরে নির্বাচন হতে পারে।’

ডিসেম্বরে না হলে সংশয় কেন?

নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বর ধরেই ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ ডিসেম্বরের পর আগামী বছরের শুরুতে রমজান, এইচএসসি পরীক্ষা এবং বর্ষার কারণে ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ভোটগ্রহণ সম্ভব নাও হতে পারে।

চাঁদ দেখা যাওয়ার ওপর নির্ভর করে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে রমজান শুরু হবে। সাধারণত বাংলাদেশে রমজানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। এ ছাড়া নির্বাচনের তারিখ এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যাতে ভোটের দিনের আগের তিন সপ্তাহের প্রচারের সময়টাও রমজান মাসে না পড়ে।

নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতে, রমজানে নির্বাচন হলে ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে যেতে পারে এবং প্রচারণা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। আবার রমজানের দুই মাস পর ঈদুল আজহা। পরে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকে নানা প্রস্তুতি শুরু হয়।

আবার আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হতে পারে। যদি ওই সময়ে পরীক্ষা হয় তাহলে এই তিন মাস নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। মে ও জুন মাসে বাংলাদেশে বৃষ্টির মৌসুম থাকে। বর্ষাকালে বৈরী আবহাওয়া, অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও বন্যার শঙ্কায় ভোটগ্রহণ অনেকটা অসম্ভব। 

এসব দিক বিবেচনা করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে তা পরবর্তী বছরের অক্টোবরের আগে সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেকে। ফলে যেসব দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়, তাদের মধ্যে নানা ধরনের আশঙ্কা কাজ করছে।