ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘোষণা

গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার জানান, শ্রমিকরা মজুরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘোষণা

প্রথম নিউজ, অনলাইন: বাংলাদেশে প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার, যা আগামী ১লা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান মঙ্গলবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করেন। তবে এই নতুন মজুরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন শ্রমিকরা। ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে যৌক্তিক মজুরি বৃদ্ধি না করার প্রতিবাদে আগামী শুক্রবার সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সভায় পোশাক কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে ১২,৫০০ টাকার ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব করা হয়। তাদের প্রস্তাবিত মজুরিই চূড়ান্ত করেছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড।

গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার জানান, শ্রমিকরা মজুরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। মজুরি বৃদ্ধির আমাদের যে দাবি সেটি সরকারকে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায়ে ১১ সংগঠন নিয়ে গঠিত ‘গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন’ প্ল্যাটফরমে আগামী শুক্রবার প্রতিবাদ সমাবেশ করবে তারা।

আরেক শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম যে হারে বেড়েছে সেই হারে মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার যে ন্যূনতম সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে তা দিয়ে কিছুই হবে না। এ কারণে আমরা এই ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করছি। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির নেত্রী তাসলিমা আখতার বলেন, আমরা তো এক বছরের বেশি সময় ধরে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা দাবি করে আসছিলাম। শ্রমিকদের কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য এই মজুরিটা দরকার। মালিকরা বলছেন, তারা ৫৬ শতাংশের মতো মজুরি বৃদ্ধি করছেন। কিন্তু বাজারে জিনিসপত্রের দাম তো ১৫০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং বাজারদরের সঙ্গে তুলনা করলে সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না। আমরা এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করছি এবং তা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি। ঘোষিত মজুরি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ১০ই নভেম্বর কর্মসূচি পালন করা হবে।

এর আগে পোশাক শ্রমিক ও মালিকপক্ষের ছয় দফা বৈঠক শেষে মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা দেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে শ্রম প্রতিমন্ত্রী সচিবালয়ে তার দপ্তরে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা এটা ঘোষণা করছি। ন্যূনতম মজুরি ৫৬.২৫ শতাংশ বাড়বে। আট হাজার টাকা থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হবে। সঙ্গে বছরে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট থাকবে। 
সর্বশেষ ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল। তাতে পোশাক শ্রমিকরা ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছিলেন। সেই হিসেবে আগের তুলনায় ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। মজুরি বৃদ্ধির হার ৫৬.২৫ শতাংশ।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল। তাতে পোশাক শ্রমিকরা ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছিলেন। সেই হিসেবে আগের তুলনায় ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগামী ১৪ দিনের মধ্যে মজুরির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন হবে। শ্রমিকদের মজুরি কাঠামোতে পাঁচটি গ্রেড থাকবে। মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৬৩ শতাংশ। 

সবশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পাঁচ বছরের জন্য পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করে সরকার। সে অনুযায়ী আগামী ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরি ঘোষণা করার দাবি ছিল শ্রমিকদের। পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে গত এপ্রিলে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। গত ২২শে অক্টোবর এই বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেন। আর মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়। ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে- এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে ২৩শে অক্টোবর থেকে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু করেন পোশাক শ্রমিকরা। পরে তা আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার মিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে।

মূলত তারা ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। এ নিয়ে গত ৩০শে অক্টোবর আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে পুলিশ ও তৈরি পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে অন্তত দুইজন নিহত এবং প্রায় ৪০ জন আহত হয়। এতে বেশ কিছু কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে চলতি সপ্তাহ থেকে বন্ধ কারখানাগুলো চালু হতে শুরু করে। পরে ঢাকার আশুলিয়ায় ৩টি কারখানা ভাঙচুর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধরের অভিযোগে আশুলিয়া থানায় পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ। মামলাগুলোতে উস্কানি ও ভাঙচুরের অভিযোগে শ্রমিকসহ দেড় হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।

এদিকে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লার সভাপতিত্বে দুপুর ১২টার দিকে শুরু হওয়া বোর্ডের সভায় অংশ নেন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম, মালিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি মকসুদ বেলাল সিদ্দিকী, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি সুলতান আহম্মদ এবং নিরপেক্ষ প্রতিনিধি কামাল উদ্দিন। এর আগের সভায় মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৪ টাকার প্রস্তাব করেন। আর মজুরি বোর্ডে পোশাক কারখানার মালিকদের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন। উভয়পক্ষ প্রস্তাবনায় তাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।

শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে মজুরি বৃদ্ধি গার্মেন্টস আন্দোলনের নেতারা বলছেন, পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করতে হবে। শ্রমিকদের গ্রেপ্তার-হত্যা-মামলা-ছাঁটাই-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে মজুরি কার্যকর করা হবে। অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হবে। এ বিষয়ে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, সভায় মালিকপক্ষের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। 

তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য বাস্তবসম্মত নিম্নতম মজুরি কাঠামো প্রস্তাবনার জন্য শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলো হচ্ছে- গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি সর্বমোট মাসিক মজুরির ন্যূনতম ৬১ শতাংশ করা; গার্মেন্টস শ্রমিকদের পদ ও শ্রেণি বিন্যাসে গ্রেডিং সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে পূর্বের ৭টি গ্রেডের পরিবর্তে ৫টি গ্রেডে ভাগ করা; মূল মজুরির ওপর ১০ শতাংশ হারে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট দিতে হবে; পর পর দুটি গ্রেডের মধ্যে ন্যূনতম মজুরির পার্থক্য ১০ শতাংশ করতে হবে; নতুন শ্রমিকদের জন্য তিন মাস শিক্ষানবিশকাল হিসেবে বিবেচিত হবে; সোয়েটার কারখানা বা পিস রেটে কর্মরত শ্রমিককে প্রোডাকশন না থাকলে বিগত ৩ মাসের মজুরির গড়/৩নং গ্রেডের বেসিক মজুরি পরিশোধ, কাজের আগে রেটের ফয়সালা করা; যে কোনো সম্প্রদায়ের শ্রমিক ও কর্মচারীরা স্ব স্ব সম্প্রদায়ের প্রধান দুটি উৎসবে প্রতিটিতে ৬ মাসের অধিক চাকরির ক্ষেত্রে এক মাসের মূল মজুরি হারে ২টি উৎসব ভাতা ও ৬ মাসের অনধিক চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিটিতে ১৫ দিনের মজুরি হারে ২টি উৎসব ভাতা প্রাপ্ত হবেন। শ্রমিকের উৎসব ভাতা ১ মাসের মূল মজুরির কম হবে না; স্বীয় পদে/গ্রেডে চাকরির সর্বোচ্চ ২ বছরের মধ্যে উচ্চতর গ্রেডে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে; মাতৃত্বকালীন ছুটি সবেতনে ৬ মাস দিতে হবে ও শ্রমিকদের পরিবারের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা দিতে হবে।

এদিকে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা দিয়েছে মজুরি বোর্ড। এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছেন শ্রমিকরা। ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে যৌক্তিক মজুরি বৃদ্ধি না করার প্রতিবাদে আগামী শুক্রবার সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মজুরি বৃদ্ধির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১১ সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন প্ল্যাটফরম। এ প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে আগামী শুক্রবার প্রতিবাদ সমাবেশ করবো।