দুবাই থেকেই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের নেটওয়ার্ক কাশিমপুর কারাগারে
প্রথম নিউজ, ঢাকা: গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে থাকা দুই দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান।
আজ সোমবার বেলা ১২টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
হাফিজ আক্তার বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও তার ভাই শামীম দুবাইয়ে পালিয়ে আছে। সেখানে বসে সে দেশের বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড করে। তাকে সহযোগিতা করে কাশিমপুর কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুন্না ও মামুন ওরফে ছক্কা মামুন। কারাগারে বসে এই দুজন আবার তাদের অনুসারীদের দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করে থাকে।
কারাগারে থাকা এই দুই সন্ত্রাসীর সঙ্গে জিসান এবং দেশে থাকা সন্ত্রাসীদের যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছে ডিবি।
পুলিশ জানায়, গত ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর পূর্ববাড্ডার আলিফ নগর এলাকার জেনারেটর ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম খান টুটুলকে গুলির পরদিন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের নামে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়া হয়। চাঁদা না দিলে তার সন্তানকে খুন করার হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী। পরে ডিবি ঘটনাস্থল থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করে। ফুটেজ পর্যালোচনা করে গত ২১ ডিসেম্বর ওই ঘটনায় অস্ত্র ব্যবহারকারী সন্ত্রাসী মো. নাসিরকে (২১) গ্রেফতার করে পুলিশ। ২২ ডিসেম্বর সে আদালতে জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে ওমর খৈয়াম নিরু, জীবন হোসেন, ফারহান মাসুদ সোহান, নাঈম, রানা ও কাওছার আহমেদ ইমনের নাম বলে সে।
নাসিরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ডিবির গুলশান জোনের টিম পার্বত্য বান্দরবান জেলার দুর্গম এলাকা থেকে গত ২৬ ডিসেম্বর দুপুরে কাওছার আহমেদ ইমনকে (২৪) গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাড্ডার বেরাইদ এলাকা থেকে একই দিন রাতে সন্ত্রাসীদের ভাড়া করা বাসা থেকে মোহাম্মদ জীবন হোসেনকে (২৫) একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন ও এক হাজার পিস ইয়াবাসহ; ওমর খৈয়াম নিরুকে একটি রিভলবার, চার রাউন্ড ২২ বোরের রিভলভারের গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন ও ৪০০ পিস ইয়াবাসহ এবং ফারহান মাসুদ সোহানকে একটি বিদেশি পিস্তল, ৫ রাউন্ড গুলি এবং ৬০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়। ইমনের তথ্য অনুযায়ী, তার ঘরের একটি ব্যাকপ্যাকের ভেতর থেকে দুই হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয় এবং একই ঘরে থাকা মো. আসালামকেও ২ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়।
হাফিজ আক্তার বলেন, ‘দুবাইয়ে অবস্থানরত জিসান ও তার ভাই শামিম এবং কাশিমপুর কারাগারে থাকা ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মামুনের ক্যাডার সোহান, ইমন, জীবন ও নিরুর টাকার প্রয়োজন হলে তারা এলাকার বড় ভাই মহিন উদ্দিন জালালের (৪৩) কাছে যায় এবং একটি টার্গেট দেওয়ার জন্য বলে। পরে মহিন উদ্দিন জেনারেটর ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম টুটুলের খোঁজ দেয়। নিরু, জীবন ও ইমন কাজটি করার জন্য নাসিরকে ঠিক করে।’
তিনি বলেন, ‘ক্যাডার জীবন হোসেন কীভাবে গুলি করতে হবে অর্থাৎ পিস্তল চালাতে হয় তা বাসের হেলপার নাসিরকে শিখিয়ে দেয়। ২০ ডিসেম্বর সকালে জীবন ও নাঈম নাসিরকে অস্ত্র দিলেও ওই দিন নাসির গুলি করতে যেতে পারেনি। পরের দিন বিকালে নাসির তার সহযোগী রানাকে নিয়ে টুটুলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হত্যার হুমকি দেয় এবং চাঁদা দেওয়ার কথা বলে গুলি করে চলে আসে। গুলি করার পরে নাসির অস্ত্রটি রামপুরা ব্রিজের কাছে গিয়ে জীবনকে ফেরত দিয়ে আসে।’
যে অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যবসায়ী টুটুলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে গুলি করা হয়, সেই অস্ত্রটি আসামি জীবনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদকালে তারা দুবাই প্রবাসী চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ক্যাডার বলে স্বীকার করে। তথ্য প্রযুক্তির উপাত্ত বিশ্লেষণে দুবাই প্রবাসী চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
হাফিজ আক্তার আরও বলেন, ‘দক্ষিণ বাড্ডায় ২০০৬ সালের ফোর মার্ডার মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে অবস্থানরত মামুন ওরফে ছক্কা মামুনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। মূলত মামুন ও ছক্কা মামুনের মাধ্যমে জিসানের সঙ্গে সন্ত্রাসী জীবনের পরিচয় হয়। দুবাইয়ে অবস্থানরত জিসান কাশিমপুর কারাগারে অবস্থানরত আসামি মামুনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে। পরে জীবনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে সোহান ও অন্যদের পরিচয় হয়। তারা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ রক্ষা করতো। এছাড়া অস্ত্র মামলায় কাশিমপুর কারাগারে থাকা আসামি মুন্নাও গ্রেফতারকৃত আসামিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতো এবং নির্দেশনা দিতো।’
তিনি বলেন, ‘জিসান একাধিকবার বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে সোহানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে সোহান স্বীকার করেছে। প্রথমদিকে জীবনের মাধ্যমে সোহানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলেও পরে সোহানসহ অন্যদের সঙ্গে জিসান সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে। জিসান, মামুন ও মাহফুজ (মামুনের ভাই হত্যা মামলায় কাশিমপুর কারাগারে অবস্থানরত) বিভিন্ন সময়ে নিরু, জীবন, সোহান, আসলামসহ অন্যদের মামলায় হাজির হওয়াসহ অন্যান্য খরচ বিকাশের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। এই ক্যাডাররা বিভিন্ন সময়ে চাঁদাবাজির মাধ্যমে টাকা তুলে মামুনকে দিয়েছে বলে জানা যায়।’
গ্রেফতার পিচ্চি আসলাম ওরফে ক্যাশিয়ার আসলাম ইতোমধ্যে অস্ত্র মামলায় ৯ বছর কারাগারে বন্দি। গ্রেফতার অন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদকসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে।
হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ব্যবসায়ী টুটুলকে যারা গুলি করেছে তারা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। কিছু সন্ত্রাসী তাদের ব্যবহার করেছে। তাদের অস্ত্র দিয়ে টাকার বিনিময়ে গুলি করে।’
এই সন্ত্রাসীদের চার জনের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। তিন জন বিএনপি ও একজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে ডিবি।
হাফিজ আক্তার বলেন, ‘যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে, তারা রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করে। গ্রেফতার সাত জনের মধ্যে তিন জন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং একজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা সবসময় চেষ্টা করে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালানোর। তবে তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অপরাধ কর্মকাণ্ড করে অর্থ আদায় করা।’
জিসানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: