তহবিল সংকটে রোহিঙ্গা শিবিরে চাকরি হারাচ্ছেন ১১৭৯ শিক্ষক

প্রথম নিউজ, কক্সবাজার: বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জীবনে যে কটি আশার প্রদীপ জ্বলছিল, তার একটি শিশুদের জন্য পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের এক ঘোষণা সেই আলো নিভে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে চার হাজার ‘লার্নিং সেন্টার’ পরিচালিত হয়ে আসছিল। এসব লার্নিং সেন্টারে পড়তো দুই লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। চলতি জুন মাসের শেষেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসব কেন্দ্র। তহবিল সংকটের কথা জানিয়ে ইউনিসেফ লার্নিং সেন্টারগুলো বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।
সোমবার সকালে কক্সবাজারের ইউনিসেফ কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির কক্সবাজার চিফ অফ ফিল্ড অফিস এঞ্জেলা কার্নে। তিনি বলেন,‘শিক্ষাকেন্দ্রগুলো আপাতত জুন মাস পর্যন্ত খোলা থাকবে। তারপর নতুন করে তহবিল না পেলে কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।’
লার্নিং সেন্টারগুলো বন্ধের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরে চলা শিক্ষা কার্যক্রমের আরও বড় ধাক্কা হলো, পাঠ্যসূচিতে ব্যাপক কাটছাঁট। পাঠ্যসূচি থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে ইংরেজি, বিজ্ঞান ও সামাজিক শিক্ষা। থাকছে কেবল বার্মিজ ভাষা, গণিত, জীবনদক্ষতা ও সামাজিক মানসিকতা শিক্ষা। এছাড়া, নতুন করে কোনো পাঠ্যবইও দেওয়া হবে না। পুরনো বই ঘুরিয়ে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে ইউনিসেফ।
লার্নিং সেন্টার বন্ধের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষকরা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গ্রেড-১ ও ২ এর আওতায় কর্মরত এক হাজার ১৭৯ বাংলাদেশি শিক্ষককে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে শিবিরসংলগ্ন এলাকার কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ এক ঝটকায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ইউনিসেফের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত কয়েকদিন ধরে উখিয়ার বিভিন্ন অংশে বিক্ষোভ করছেন স্থানীয় শিক্ষকরা। সড়ক অবরোধ করে উন্নয়ন সংস্থার যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। শিক্ষকদের দাবি, রোহিঙ্গাদের রেখে স্থানীয়দের চাকরি থেকে সরানো হচ্ছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়রা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
স্থানীয়দের চাকরির দাবিতে আন্দোলন করা সাফফাত ফারদিন চৌধুরী বলেন, ‘হোস্ট এরিয়া উখিয়া মগের মুল্লুক নয়, যে যখন যা খুশি সিদ্ধান্ত নেবেন। হোস্ট কমিউনিটির টিচারদের অন্যায়ভাবে অপসারণের চেষ্টা করা হলে আমরা ছাড় দেব না। সব কিছুর ফান্ড থাকে হোস্ট কমিউনিটির বেলায় ফান্ড থাকে না। এ খেলা বন্ধ করতে হবে।’
বিষয়টি নিয়ে ইউনিসেফ কর্মকর্তা এঞ্জেলা কার্নে বলেন, ‘এখানে কোনো বৈষম্য নেই। এটা শুধুমাত্র তহবিল সংকটের কারণে নেওয়া সিদ্ধান্ত। আমাদের এখানে তিন হাজারের অধিক বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক কাজ করেন। যেখান থেকে শুধুমাত্র গ্রেড ১ ও ২ ভুক্তরা থাকছে না।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইউনিসেফ পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তহবিল সংকটের কথা বলে ইউনিসেফ ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্যাম্পের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এতে রোহিঙ্গা শিশুদের বার্মিজ কারিকুলামের মাধ্যমে জাতিগত পরিচিতি ও জাতীয়তাবোধ গঠনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় পড়তে পারে।’
মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিশুরা যদি নিজের দেশের ইতিহাস, ভাষা ও জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে না শেখে, তবে নিজ মাতৃভূমির প্রতি তাদের ভালোবাসা ও টান হারিয়ে যেতে পারে। তাই আমরা যেকোনো মূল্যে এ শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার পক্ষে।’
এ সিদ্ধান্তের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানেও বড় ধরণের প্রভাব পড়বে জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, ‘ক্যাম্পভিত্তিক স্কুল ও সহায়ক কার্যক্রমে কয়েক হাজার স্থানীয় শিক্ষক এবং কর্মী যুক্ত। তারা চাকরি হারালে ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। স্থানীয় জনগণ ১২ থেকে ১৩ লাখ রোহিঙ্গার চাপ সহ্য করছেন। এখন চাকরিচ্যুতির ধাক্কাও তাদের ওপর পড়লে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ইউনিসেফকে বিষয়টি জানিয়েছি এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। তারা বলছে, তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। আমরাও নিজেদের জায়গা থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী টিকে অং মাইয়েং বলেন, ‘লার্নিং সেন্টার বন্ধ হলে রোহিঙ্গা শিশুদের মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে। কারণ, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় লার্নিং সেন্টারগুলো শিশুদের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় হয়ে আছে।’
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিচ এন্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মো. জোবায়ের বলেন, ‘আমাদের রোহিঙ্গা শিশুরা বিশ্বের সবচেয়ে অসহায়। এদের কাছে শিক্ষাটা বিলাসিতা নয়। মানবিক সংকটের সময়ে এ অসহায় শিশুরা শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আশান্বিত হয়। নিয়মশৃঙ্খলা শেখে। কিন্তু, যে ধরণের খবর শুনলার এটা আমাদের মর্মাহত করে।’