জিল্লুর রহমানকে ‘হয়রানি’, ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস-এর উদ্বেগ
প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশের জনপ্রিয় টকশো ‘তৃতীয় মাত্রা’র উপস্থাপক ও পরিচালক জিল্লুর রহমানকে হয়রানি করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ করে তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে ডাবলিন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বুধবার (১৩ই সেপ্টেম্বর) এ নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৯ই আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনস্থ গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) মানবাধিকারকর্মী জিল্লুর রহমান এবং সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) অ্যাকাউন্ট বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহের জন্য দেশের সকল ব্যাংককে অনুরোধ করেছিল।
জিল্লুর রহমানকে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং জনপ্রিয় লেট-নাইট টক শো “তৃতীয় মাত্রা”র উপস্থাপক পরিচয় দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, এসব পরিচয়ের বাইরে তিনি সিজিএস নামক বাংলাদেশ ভিত্তিক সুশীল সমাজ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক। গণতন্ত্র এবং টেকসই উন্নয়ন সহ সুশাসন নিশ্চিতে সিজিএস বিভিন্ন অংশীদারদের সহযোগিতা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। মানবাধিকার সংক্রান্ত মামলাগুলো (বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে সিজিএস একটি নেতৃস্থানীয় সুশীল সমাজ সংগঠন। সিজিএস-এর আগে জিল্লুর রহমান বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে কাজ করেছেন।
বিএফআইইউ ইঙ্গিত দিয়েছে যে ৯ই আগস্টের উক্ত পদক্ষেপ একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার অনুরোধের প্রেক্ষিতে করা হয়েছিল। সেটি কোন সংস্থা তা অবশ্য তারা প্রকাশ করেনি। এভাবে স্বচ্ছতার অভাবের কারণে এই অনুসন্ধানগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা ডানা মেলেছে। এর ফলে সিজিএস সহ বাংলাদেশের অন্যান্য সুশীল সমাজ সংগঠনগুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জিল্লুর রহমান এবং সিজিএস নিজেদের বৈধ মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজ করতে গিয়ে যে-সব হয়রানির শিকার হয়েছেন, এটি তার সর্বশেষ উদাহরণ।
বাংলাদেশে মানবাধিকারকর্মীরা যে-সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তার উপর তৈরি একটি প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য ২০২৩ সালের ২৭শে জুলাই সিজিএস একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মানবাধিকারকর্মী, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, বিদেশি মিশনের প্রতিনিধিরা ছাড়াও শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজের সদস্যসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মীরা নিজেদের কাজ করতে গিয়ে যে-সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন সেটি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্যই মূলত ওই গবেষণা করা হয়েছিল। মানবাধিকারকর্মীরা নিজেদের কাজ করতে যে অনিরাপদ থাকেন এবং নানা বাধার সম্মুখীন হন তা নথিভুক্ত করে গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানের পর প্রতিবেদনের মূল উপস্থাপককে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা ও মন্তব্য করার যোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়ে আক্রমণ করে প্রশ্ন করা হয়। এই রিপোর্টগুলো ছাড়াও সিজিএস এর অন্যান্য কাজগুলোকে লক্ষ্য করে সংঘবদ্ধ মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। সিজিএস-এর বৈধ মানবাধিকার কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় এসব প্রচারণা শুরু করা হয়েছিল। এর আগে সিজিএর-এর আরেক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছিল যে, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়া হাউসগুলোর মালিক হলেন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদ কিংবা ব্যবসায়ীরা।
২০২২ সালের ২৩শে ডিসেম্বর পুলিশ শরীয়তপুর জেলায় জিল্লুর রহমানের পৈতৃক বাড়িতে যায়। ওই ঘটনায় দেশের সাংবাদিক সমাজের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য সমালোচনা জন্মলাভ করে। পুলিশ জিল্লুরের আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে, তার কাজ এবং কথিত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানবাধিকারকর্মী জিল্লুর এই ধরনের ভয় দেখানোর প্রভাব নিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘(পুলিশের) যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল আমাকে, আমার পরিবার এবং প্রতিবেশীদের ভয় দেখানো। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজ এবং থিংক ট্যাংক সিজিএস সম্পর্কিত কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করা।’’
২০২২ সালের ২৩শে নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) সিজিএস-এর লেনদেন এবং আর্থিক বিষয়ে জিল্লুর রহমান এবং সিজিএস-এর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। সিজিএস-এর বিভিন্ন ইভেন্ট (যেমন; বে অফ বেঙ্গল কনভারসেশন) যে-সব স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সেইসব স্থান পরিদর্শন করে। গোয়েন্দারা হোটেলের কর্মচারী এবং ইভেন্ট পার্টনারদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
ওদিকে আন্তর্জাতিক ওই সম্মেলন চলাকালে সরকার ‘মিডিয়া কাভারেজ’ বর্জন করায়। উপরন্তু, জিল্লুর রহমানকে নজরদারিতে রাখা হয় এবং গোয়েন্দারা তাকে অনুসরণ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, সিজিএস-এ কর্মরত বেশ কয়েকজনকে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বারংবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাছাড়া, অজানা লোকেরা বারবার জিল্লুর রহমানের, তৃতীয় মাত্রার এবং সিজিএস-এর ফেসবুক ও টুইটার পেজ হ্যাক করার চেষ্টা চালায়। এই সমস্ত ঘটনা সিজিএস-এ কর্মরতদের মাঝে ক্রমাগতভাবে ভীতির সঞ্চার করেছে, তাদের কর্মক্ষমতাকে ব্যাহত করছে।
উপসংহারে বলা হয়, ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস বিশ্বাস করে যে, জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে হয়রানি সরাসরি তার বৈধ মানবাধিকার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই মানবাধিকারকর্মীর মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতা নিয়ে ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস গুরুতরভাবে উদ্বিগ্ন।