ছাত্রলীগের কমিটিতে ‘মাই ম্যান’ রাজনীতি ও অঞ্চলপ্রীতি
দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় সাত মাস পর গত বৃহস্পতিবার রাতে ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করেন সাদ্দাম-ইনান।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ৩০তম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দায়িত্বে আসেন সাদ্দাম হোসেন ও শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। নেতৃত্বে আসার পর গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিতর্কিতদের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদায়ন না করার ঘোষণা দিয়েছিলেন এ দুই শীর্ষ নেতা।
দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় সাত মাস পর গত বৃহস্পতিবার রাতে ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করেন সাদ্দাম-ইনান। তবে সে কমিটিতে নিজেদের কথা রাখতে পারেননি এ দুই নেতা। কমিটিতে শিক্ষার্থী নির্যাতনকারী, চাঁদাবাজ ও নিষ্ক্রিয়দের পদায়ন করার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া কমিটিতে ‘মাই ম্যান’ রাজনীতি ও অঞ্চলপ্রীতির কারণে অনেক যোগ্যরা বঞ্চিত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনেক পরিশ্রম এবং ধৈর্য নিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে চেয়েছি। ‘মাই ম্যান’ রাজনীতির কারণে আমাকে বাদ পড়তে হয়েছে। আমি আজ স্বীকার করলাম আমার রাজনৈতিক প্যাটার্ন ভুল। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তারা বলছেন সব অঞ্চলকে সমান চোখে দেখা হয়েছে। ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি করা হয়েছে ৭১ জনকে। এর আগে এই পদে ৬১ জনকে পদায়ন করা হতো। এবার ১০ জন বাড়ানো হয়েছে। কমিটিতে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ১১ জন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন ১১ জন।
কমিটিতে তো সবাইকে পদ দেওয়া সম্ভব হয় না। কেউ কেউ বাদ পড়বেই। এছাড়া কমিটি গঠনে কিছু ভুলত্রুটিও থাকে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। ভুল থাকলে আমরা সেটি সংশোধন করে নেব। ঘোষিত কমিটিতে সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের উত্তরবঙ্গ এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের বরিশাল অঞ্চল থেকে জায়গা পেয়েছেন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নেতা। সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৯০ জন। এর মধ্যে আছেন সহ-সভাপতি ১৪ জন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ৩ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ৬ জন, সম্পাদক ১০ জন, উপ-সম্পাদক ৩৯ জন, সহ-সম্পাদক ৬ জন।
মাই ম্যান রাজনীতি ও অঞ্চলপ্রীতির কারণে দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক পদ প্রত্যাশী এবার কমিটিতে স্থান পাননি। যাদের অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তাদের দাবি, দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থেকেও এবং কোনো ধরনের কমিটিতে না থেকেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন অনেকে।
প্রত্যাশা থাকলেও পদ পাননি মাহমুদুল হাসান নামে এমন একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অনেক পরিশ্রম এবং ধৈর্য নিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে চেয়েছি। মাইম্যান রাজনীতির কারণে আমাকে বাদ পড়তে হয়েছে। আমি আজ স্বীকার করলাম আমার রাজনৈতিক প্যাটার্ন ভুল। আমাকে যারা ভালোবাসেন তাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। রাজনৈতিক কারণে যারা ভালোবাসেন তাদের কাছে আরও বেশি ক্ষমা চাই। হল রাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি, ডাকসু, সেন্ট্রাল রাজনীতি করেছি। যেভাবে শূন্য হাতে শুরু করেছিলাম সেভাবেই বিদায় দিল কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ যা চায় তা-ই হয়।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য লিখেছেন, সম্পাদক পদের ৮টি এবং সহ-সভাপতি পদে ১০টি বাড়িয়ে কর্মীদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন সাদ্দাম-ইনান। তবে কমিটি কিছুটা আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে নিয়ে যে বিকেন্দ্রীকরণ করার কথা সেটা আশানুরূপ পরিলক্ষিত হয়নি। এদিকে চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে না রাখার নির্দেশনা থাকলেও এবারের কমিটিতেও স্থান হয়েছে তাদের। যদিও ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দাবি ‘প্রমাণিত অভিযুক্ত’ কাউকে রাখা হয়নি।
কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পাওয়া অনেক নেতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, আর্থিক অনিয়ম এবং সংগঠনে অনিয়মিত ও নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ তুলেছেন পদবঞ্চিত নেতারা। নতুন কমিটির ১নং সহ-সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সহ-সভাপতি সজীব নাথের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পূর্ববর্তী কমিটিতে থাকাকালীন কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। সহ-সভাপতি সাইফুল্লাহ অনন্ত আব্বাসীর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ আছে। সহ-সভাপতি আল আমিন রহমানের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও জাসদ ছাত্রলীগ করার অভিযোগ রয়েছে। সহ-সভাপতি উৎপল বিশ্বাস ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া তার বিরুদ্ধে সাংবাদিক হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে। সহ-সভাপতি শেখ শামীম তুর্যের বিরুদ্ধে নারী-ঘটিত অপরাধ এবং কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। সহ-সভাপতি নাজিম উদ্দিনের পরিবার জামায়াত-বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিগত কমিটিতে তার বিরুদ্ধে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছিল। আরেক সহ-সভাপতি মো. শাহজালাল একটি মামলার আসামি।
সহ-সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে ইডেন কলেজে শিক্ষার্থী নির্যাতন, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। রিভার অডিও ফাঁসকাণ্ডে সারা দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। সিট বাণিজ্যসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ এনে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরা। আমরা সময় নিয়ে যাচাই-বাছাই করেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছি। আমাদের জানা মতে অভিযুক্ত কাউকে পদায়ন করা হয়নি। তবুও কেউ যদি তথ্য ভুল দেয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিটি সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ হীল বারীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ রয়েছে। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দীন রানার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন, বিরোধী পক্ষের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক সিয়াম রহমানের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। উপ-সম্পাদক রিয়াজুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের ছাত্র সংগঠনের প্রোগ্রামে হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ক্রীড়া সম্পাদক মেহেদী হাসান শান্তর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন, উপসম্পাদক মারিয়াম জামান সোহানের বিরুদ্ধে চাকরি করার অভিযোগ রয়েছে।
উপ-পাঠাগার সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন ও চাঁদাবাজি এবং আইন সম্পাদক তাওহীদ বণীর বিরুদ্ধে ছাত্রত্ব না থাকার অভিযোগ রয়েছে। উপসম্পাদক তানজীন আল আমিনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তা, আমির হামজার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত ইমদাদুল হাসান সোহাগকে উপ-বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। উপ-বিজ্ঞান সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম জাহিদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য এবং উপ-সাহিত্য সম্পাদক আকলিমা আক্তার প্রভাতীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং সদস্য জেবুন্নাহার শিলার বিরুদ্ধে চাকরি করার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ ওঠা নেতাকর্মীদের পক্ষে কথা বলছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তারা বলছেন, অভিযোগ কম বেশি অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে। তবে ‘প্রমাণিত’ অভিযুক্ত তেমন কেউ নেই। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘আমরা সময় নিয়ে যাচাই-বাছাই করেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছি। আমাদের জানামতে প্রমাণিত অভিযুক্ত কাউকে পদায়ন করা হয়নি। তবুও কেউ যদি তথ্য ভুল দেয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিটি সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।’
ঘোষিত কমিটিতে সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের উত্তরবঙ্গ এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের বরিশাল অঞ্চল থেকে জায়গা পেয়েছেন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নেতা। সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৯০ জন। এর মধ্যে আছেন সহ-সভাপতি ১৪ জন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ৩ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ৬ জন, সম্পাদক ১০ জন, উপ-সম্পাদক ৩৯ জন, সহ-সম্পাদক ৬ জন। অঞ্চলপ্রীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অঞ্চলকে প্রাধান্য দিইনি। পরিশ্রম, মেধা ও রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে কমিটি ঘোষণা করেছি। কোনো অঞ্চলে রাজনীতি করা নেতাকর্মীর স্বল্পতা থাকলে অন্য অঞ্চল থেকে কিছু পদ বেশি পাওয়া স্বাভাবিক। যারা পদে আসতে পারেনি তাদের প্রতি আমার সমবেদনা রইল। রাজনীতি একটা দীর্ঘ সময়ের বিষয়। তাদের আমি ধৈর্য ধরে লেগে থাকার পরামর্শ দেব।’
সার্বিক বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘কমিটিতে তো সবাইকে পদ দেওয়া সম্ভব হয় না। কেউ কেউ বাদ পড়বেই। এছাড়া কমিটি গঠনে কিছু ভুলত্রুটিও থাকে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নয়। ভুল থাকলে আমরা সেটি সংশোধন করে নেব। যুগোপযোগী করা এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলঅর জন্য বৈশ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা নতুন ৮টি পদও তৈরি করেছি। স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট ছাত্র রাজনীতির উদাহরণ সৃষ্টি করা আমাদের লক্ষ্য।’