কমছে ঘূর্ণিঝড়-লঘুচাপ, আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের শঙ্কা

ঊর্ধ্ব আকাশে পশ্চিমা বাতাসের গতিবেগ বাড়ায় হচ্ছে না লঘুচাপ, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে খাদ্য সংকটের সঙ্গে উৎপাদন কমে যাবে, বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাষ্পায়নের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে মাটিতে পানির পরিমাণ কমছে

কমছে ঘূর্ণিঝড়-লঘুচাপ, আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের শঙ্কা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ও লঘুচাপের পরিমাণ। আবার বঙ্গোপসাগরে যেসব লঘুচাপ সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলোও সাধারণত চলে যাচ্ছে ভারতের মধ্যাঞ্চলে। ফলে সময় মতো লঘুচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ে না বাংলাদেশে।  লঘুচাপ ও ঘূণিঝড়ের প্রভাব কমে গেলে বাংলাদেশে বৃষ্টি কম হওয়াসহ বঙ্গোপসাগরে প্রাণীদের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। বেশির ভাগ লঘুচাপ ও ঘূর্ণিঝড় ভারতের দিকে চলে যাওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্যে ভয়ংকর বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

আবহাওয়াবিদরা জানান, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাষ্পায়নের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাষ্পায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় সারা পৃথিবীতে এর বিভাজন প্যাটার্নে পরিবর্তন এসেছে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্ব আকাশে বায়ুর গতিবেগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের বায়ুর গতিবেগের পার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও পূবালী লঘুচাপের বর্ধিতাংশ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে পড়ার প্রবণতা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। ফলে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ক্রমাগত লঘুচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির হারও কমে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আবহাওয়ার নানাবিধ চারিত্রিক পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করার সময় ঘূর্ণিঝড়ের নানাবিধ চারিত্রিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে ২০০০ সাল থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা। এছাড়া, ১৯৯১-২০২১ সালের মধ্যে ডিসেম্বরে একবারও কোনো ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানেনি। ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হলেও গত ২০ বছরে এ মাসে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের দেখা মেলেনি।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, উপকূল অতিক্রম করার সময় কোনো কোনো ঘূর্ণিঝড়ের বডি মুভমেন্ট কমে যাচ্ছে এবং বেড়ে যাচ্ছে। বডি পার্ট অতিক্রম করা ঘূর্ণিঝড় কখনও কখনও স্বতন্ত্র চরিত্র প্রকাশ করছে। এজন্য কোনো কোনো ঘূর্ণিঝড় অতি তীব্র বেগেও উপকূল অতিক্রম করে, আবার কোনো কোনো ঘূর্ণিঝড় দুর্বলভাবে উপকূল অতিক্রম করে। ঘূর্ণিঝড়ের এই রহস্যময় আচরণের জন্য আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের বেগ পোহাতে হচ্ছে।  

ঘূর্ণিঝড় কমে যাওয়ার সার্বিক বিষয়ে  বিস্তারিত জানান বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি ১৮৯১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের সার্বিক পরিসংখ্যানের বিষয়টি জানান।

ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ঘূর্ণিঝড় কেন হয়, এটা আমাদের জানতে হবে। আমাদের এই অঞ্চলে সাগরের দুটি পার্ট আছে। একটি আরব সাগর এবং অপরটি বঙ্গোপসাগর। ১৮৯১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে মোট ৬৬৩টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে সিজনাল প্যাটার্ন আছে। বছরে দুটি মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় হয়। প্রথম মৌসুমটি মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে এবং দ্বিতীয় প্যাটার্ন হচ্ছে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে।
 
১৮৯১ থেকে ২০২২ সালে আরব ও বঙ্গোপসাগরে প্রথম প্যাটার্নে অর্থাৎ মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ১৩২টি। দ্বিতীয় প্যাটার্নে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মোট ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ৩২৮টি। এর মধ্যে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে ২৩৮টি।

তিনি বলেন, ১৮৯১ সাল থেকে ২০২২ সালে শুধু বঙ্গোপসাগরে ৫২৭টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ১৪৩টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে এবং মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে তৈরি হয়েছে ৬১টি ঘূর্ণিঝড়। দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মোট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে এরকম ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ৫০টি। মার্চ-এপ্রিল-মে মাসজুড়ে ১৮৯১ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড় সংখ্যা ৪১টি, ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ৩৪টি এবং ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ২২টি।

অন্যদিকে, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসজুড়ে ১৮৯১ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ১০২টি। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ১১৭টি এবং ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ৫০টি। এটা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছ যে এই দুই মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- ঘূর্ণিঝড় তৈরির জন্য আরেকটি নিয়ামক ফ্যাক্টর হলো ঊর্ধ্ব আকাশে বাতাসের গতিবেগ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের বাতাসের গতিবেগের পার্থক্য কম হওয়া। বাতাসের গতিবেগের পার্থক্য কম হলে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ইদানিং পরিলক্ষিত হচ্ছে যে ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাসের গতিবেগ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের বাতাসের গতিবেগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতাসের গতিবেগ এরকম বৃদ্ধি পেলে সাগরের লঘুচাপ থেকে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সুযোগ কমে যায়
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথম কারণ হচ্ছে- গ্লোবাল ওয়ার্মিং। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাষ্পায়নের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাষ্পায়ন বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একটু বৃদ্ধি পায়। এটা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশনের প্যাটার্নে পরিবর্তন এসেছে। যেমন- ঘূর্ণিঝড় ফরমেশন হতে হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা সাড়ে ২৬ ডিগ্রি হতে হবে। সারাবিশ্বেই গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশনে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বিভাজনে ব্যত্যয় সৃষ্টি হয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- ঘূর্ণিঝড় তৈরির জন্য আরেকটি নিয়ামক ফ্যাক্টর হলো ঊর্ধ্ব আকাশে বাতাসের গতিবেগ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের বাতাসের গতিবেগের পার্থক্য কম হওয়া। বাতাসের গতিবেগের পার্থক্য কম হলে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ইদানিং পরিলক্ষিত হচ্ছে যে ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাসের গতিবেগ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের বাতাসের গতিবেগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতাসের গতিবেগ এরকম বৃদ্ধি পেলে সাগরের লঘুচাপ থেকে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সুযোগ কমে যায়।

তৃতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরসহ তিনটি সাগর পাড়ি দিয়ে পূবালী লঘুচাপের বর্ধিতাংশ যখন বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়, তখনই লঘুচাপগুলো শক্তিমাত্রা অর্জন করে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গত ১০০ বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পূবালী লঘুচাপের বর্ধিতাংশ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে পড়ার প্রবণতা কমে গেছে। এজন্য বঙ্গোপসাগরেও ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রবণতা কমে গেছে। এছাড়া আরও অনেক মেট্রলোজিক্যাল উপাদানের প্যাটার্নের পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলেও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা কমে গেছে।

আরেকটা উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, আমাদের পশ্চিমা বাতাসের গতিবেগ একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্চ, এপ্রিল, মে, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঊর্ধ্ব আকাশে পশ্চিমা বাতাসের গতিবেগ কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বঙ্গোপসাগরে যেসব লঘুচাপ তৈরি হয়, সেগুলো ঘনীভূত হওয়ার প্রবণতা কমে গেছে।
 
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এসব কারণে ১৮৯১ থেকে ২০২২ সালে যেসব ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছে তার ফ্রিকোয়েন্সি এবং সংখ্যা কমে গেছে। শুধু ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রবণতা নয়, বর্ষাকালে যেসব নিম্নচাপ তৈরি হতো সেগুলোও কমে যাচ্ছে। তবে, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার তীব্রতা বৃদ্ধির সময় যদি কোনো ঘূর্ণিঝড় হয়, তখন সেগুলো অনেক সময় শক্তিমাত্রা অর্জন করে। এজন্য ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যেসব ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছে, সেগুলোর শক্তিমাত্রা বেশি ছিল।’

কোন বছর থেকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা কমেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৯৮১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রবণতাটা কমে গেছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি ছিল।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৯৯০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ডিসেম্বরে মাত্র একটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। তবে, ১৮৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শুধু ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে সাতটি ঘূর্ণিঝড়। এছাড়া ১৯৪৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে মাত্র চারটি ঘূর্ণিঝড়। ১৯৮১ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে একটি ঘূর্ণিঝড়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ডিসেম্বর মাসে ওই একটিই ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ১৯৯০ সালে দেশের চট্টগ্রাম দিয়ে অতিক্রম করেছিল। এরপর ডিসেম্বর মাসে আর কোনো ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেনি। এতেই বোঝা যাচ্ছে দিনদিন ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের মুখোমুখি রয়েছে বাংলাদেশ।

আবহাওয়ার স্বাভাবিক আচরণ থাকা ভালো। আবার অতিরিক্ত বেশি হলেও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং কম হলে সেটাও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। এজন্য যেটা আগে অব্যাহত ছিল সেটাই থাকা ভালো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্প্রতি আবহাওয়ার পরিমণ্ডলে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাগর যেভাবে উত্তপ্ত থাকার কথা বা বঙ্গোপসাগরে যে উপাদানগুলো ঘূর্ণিঝড়কে ত্বরান্বিত করে সেগুলো কিন্তু থাকতে পারছে না। ফলে যখন এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে, তখন পরপর হচ্ছে। আবার যখন হচ্ছে না, তখন দীর্ঘবিরতির পর হচ্ছে
ড. আবুল কালাম মল্লিক, আবহাওয়াবিদ
শুধু বঙ্গোপসাগরে কত ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৮৯১ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে মোট ৪১১টি। ১৯৮১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে ১১৬টি। মূলত ১৯৮১ সালের পর থেকে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
 
ঘূর্ণিঝড় কমে যাওয়া প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, আবহাওয়ার স্বাভাবিক আচরণ থাকা ভালো। আবার অতিরিক্ত বেশি হলেও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং কম হলে সেটাও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। এজন্য যেটা আগে অব্যাহত ছিল সেটাই থাকা ভালো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্প্রতি আবহাওয়ার পরিমণ্ডলে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাগর যেভাবে উত্তপ্ত থাকার কথা বা বঙ্গোপসাগরে যে উপাদানগুলো ঘূর্ণিঝড়কে ত্বরান্বিত করে সেগুলো কিন্তু থাকতে পারছে না। ফলে যখন এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে, তখন পরপর হচ্ছে। আবার যখন হচ্ছে না, তখন দীর্ঘবিরতির পর হচ্ছে।

‘বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে যদি আরও একটি ঘূর্ণিঝড় আসতো তাহলে এই শীতকালের আগে বাংলাদেশ আরও কিছু বৃষ্টি পেত। বৃষ্টিপাতটা আমাদের শীতকালীন ফসলের জন্য খুবই উপকারী। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। ফলে ক্রমাগতভাবে মাটির জলীয়বাষ্প ও মাটিতে যে পানি থাকার কথা তার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে ফসলের চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য অতিরিক্ত ঘূর্ণিঝড়ও ভালো নয় আবার অতিরিক্ত খরাও ভালো নয়। এটা স্বাভাবিক থাকাই ভালো।’

আবদুল মান্নান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ কমে গেলে বোঝা যায় যে সাগরে স্বাভাবিক আচরণ থাকছে না। সাগরে কিন্তু বিভিন্ন প্রসেসের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উৎপাদন হয়। যেগুলো সাগরের প্রাণীদের জন্য উপকারী আবার মানুষের জন্যও। দীর্ঘদিন যদি ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ কম থাকে, তাহলে পরোক্ষভাবে জলবায়ুর মধ্যেই পরিবর্তন চলে আসবে। বিশেষ করে গত দুই বছর ধরে এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

‘যেমন- ভারতে যেসব জায়গায় বৃষ্টির অভাবে ফসল ফলানো যেত না, গত দুই বছর ধরে কিন্তু সেখানে ব্যাপক ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে না কিন্তু লঘুচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এই লঘুচাপগুলো ভারতীয় উপকূলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কারণে ভারতের উপকূলবাসী এবং তাদের মধ্যাঞ্চলগুলোতে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তার মানে, বৃষ্টিহীন জায়গাগুলো এখন বৃষ্টিবহুল হয়ে যাচ্ছে এবং বৃষ্টিবহুল জায়গাগুলো বৃষ্টিহীন হয়ে যাচ্ছে। এতে শুধু জনজীবন নয়, অন্যান্য বিষয়গুলোতেও পরিবর্তন চলে আসবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার বর্ষাকালে যেসব লঘুচাপ হয়েছিল সেগুলোর প্রায় সবগুলো ভারতের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ফলে এবার বর্ষাকালে বাংলাদেশে তাপপ্রবাহ হয়েছে। বাংলাদেশে লঘুচাপগুলো না আসার ফলে গত দুই বছর যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত পাওয়ার কথা ছিল, সেই পরিমাণ হয়নি। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্রতিবারই চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। মাঝে মাঝে ভূমিধসের ঘটনাও ঘটে। এ বছর মাত্র একদিন অথবা দুদিন চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেভাবে বৃষ্টিপাত হয়নি। এতে ওখানকার চাষিরা তেমনভাবে ফসল ফলাতে পারেননি। এজন্য স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি উৎপাদন কমে যাবে এবং নানাবিধ রোগের প্রকোপ বাড়বে।

‘ঘূর্ণিঝড় বা লঘুচাপের সংখ্যা কমে যাওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য খারাপ দিক আছে। মানে, কমে গিয়ে দুটি জায়গায় যদি একটা হয়, তাহলে এর ব্যাপকতা বেশি থাকবে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক হবে। যেমন- এবার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সিগন্যাল একদিকে থাকলেও এটা বিভিন্ন দিকে ঘুরে গেছে। এবার দেখা গেছে, দেশের যেসব এলাকা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবমুক্ত ছিল, সেসব এলাকা ঘূর্ণিঝড়ের আওতায় যুক্ত হয়েছে।’
 
জলবায়ুর এই পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগপূর্ণ দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরফ পড়া ছাড়া আমাদের দেশে সব ধরনের দুর্যোগ আছে। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনুপস্থিতির কারণে আরেকটির প্রভাব বেশি পড়ছে। যেমন- এবার ঘূর্ণিঝড় সেভাবে না হলেও বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি ছিল। দুর্যোগ একটি ফর্মে না এসে অন্য ফর্মে আসছে। এজন্য বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে জিওগ্রাফি দক্ষিণ ও উত্তর থেকে দুর্যোগ আসে, সেসব দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom