'উপরের নির্দেশে মোরশেদকে মেরে ফেলা হচ্ছে'
পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন হাজারিকে বলতে শুনি, ‘উপরের নির্দেশে তারে (মোরশেদ) মেরে ফেলা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবে না। যারা আসবে তাদেরও অবস্থা খারাপ হবে।

প্রথম নিউজ,কক্সবাজার: কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে পাশবিক নির্যাতনে নিহত মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোরশেদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার আসরের নামাজের পর শোকাবহ পরিবেশে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। মসজিদের মাঠ ছেড়ে চাষ বন্ধ থাকা খালি মাঠে পড়ানো জানাজায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন, শুভার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা।
এদিকে আইনি প্রক্রিয়া শেষে শুক্রবার দুপুরে মোরশেদের মরদেহ পিএমখালীর মাইজপাড়া গ্রামের বাড়িতে আনা হলে স্ত্রী নাসরিন সুলতানা রেখা, মেয়ে স্বপ্নমনি (১০), মরিয়ম (৭) ও ছেলে সুজনসহ (৫) স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।
ছোট ছোট সন্তানদের আর্তনাদ দেখে বৃহস্পতিবার দিনেদুপুরে ঘটা এ নৃশংসতার কেউ প্রতিবাদ করেনি কেন এ নিয়ে জানাজায় আসা লোকজনের মাঝে আলোচনা ও সমালোচনাও চলে। তখন ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, যারা আক্রমণ করছিলেন তাদের নিরাপদ রাখতে এক ধরনের বেষ্টনী করে ছিলেন আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের কয়েক নেতা। কেউ যেন প্রতিহত করতে না পারে, সেজন্য বলছিলেন- ‘উপরের নির্দেশে মোরশেদকে মেরে ফেলা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবে না। এলে পরণতি খারাপ হবে।’
এমন হুমকি দিয়ে জনসম্মুখেই রোজাদার যুবক মোরশেদকে মধ্যযুগীয় কায়দায় কুপিয়ে ও পিটিয়ে রেখে যায় নরপিশাচরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানায়, বিল্ডিং ভাঙার কাজে ব্যবহৃত বিশালাকার হাতুড়ির প্রথম আঘাতেই মাটিতে পড়ে যান মোরশেদ। ঘটনার আকস্মিকতা উপলব্ধি করতে পেরে হামলাকারীদের বলছিলেন, ‘আমি রোজায় বেশি ক্লান্ত, ইফতারের সুযোগ দাও, মারতে চাইলে ইফতারের পর মারিও। কিন্তু রোজাদার বলার আকুতিও তাদের দমাতে পারেনি। শেষরক্ষা হয়নি প্রয়াত শিক্ষক ওমর আলীর ছেলে মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোরশেদের (৩৮)।
এদিকে যেখানে মোর্শেদকে পৈশাচিকতায় হত্যা করা হয় সেই ঘটনাস্থলে গিয়ে রক্তের দাগ ছুঁয়ে বসে বিলাপ করছিলেন মোরশেদের মা হালিমা খাতুন (৬৫)। কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘সারাদিন রোজা রাখা আমার আদরের ছেলেটাকে ইফতার করতে দিলো না পাষণ্ডরা। ঘাতকরা আল্লাহর দোহাই পর্যন্ত মানলো না। আল্লাহ আমার সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা এই নরপিশাচদের বিচার তুমি দুনিয়াতেই দেখাও। এ নির্মমতা যেন আর কোনো মাকে দেখতে না হয় খোদা।’
চেরাংঘর বাজারে সন্তানের রক্তের দাগের পাশে মায়ের এ আহাজারি বাজারে উপস্থিত সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে। প্রতিবেশী, বাজারে আসা ক্রেতা-বিক্রেতা ও আত্মীয়স্বজনেরা তাকে বারবার সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাবাজার এলাকার আলী আহমদ কোম্পানি জানান, বাজার করতে চেরাংঘর বাজারে পৌঁছানোর একটু পর শোরগোল শুনতে পাই। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গেলে পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন হাজারিকে বলতে শুনি, ‘উপরের নির্দেশে তারে (মোরশেদ) মেরে ফেলা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবে না। যারা আসবে তাদেরও অবস্থা খারাপ হবে।
এ সময় আবদুল মালেকসহ ১৫-২০ জন স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী মোরশেদকে প্রহার ও কোপাচ্ছিলেন। সবাইকে তদারকি করছিলেন পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল। এলোপাতাড়ি মারধর ও কোপানোর ফলে মোরশেদ একটু নিস্তেজ হয়ে গেলে কয়েক রাউন্ড ফাকা গুলি বর্ষণ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে হামলাকারীরা। একই ধরনের তথ্য জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরো একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।
জঘণ্য এ হত্যাকাণ্ডে পিএমখালী ইউনিয়ন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেকের নাম এলেও তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। কিন্তু জানাজা পূর্ব বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের আওয়ামী লীগ করার কোনো সুযোগ নেই, এটি দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ। এ দলে ভূমিদস্যু-চাঁদাবাজ, হুকুম দখল ও খারাপ মানুষের জায়গা নেই।‘
জানাজায় শোকাহত হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মোরশেদকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, আমি বেঁচে থাকতে সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগের কেউ হতে পারে না। পার্টিতে যদি এদের কারো নাম থেকেও থাকে সমস্ত নাম এই মুহূর্ত থেকে বাদ হয়ে গেছে।
জানাজায় অন্যদের মাঝে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আব্বাস উদ্দিন, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাহামুদুল করিম মাদু, যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, স্থানীয় চেয়ারম্যান মো. আবদুল্লাহ এবং মরহুমের নিকটাত্মীয় আবুল কালামসহ সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য রাখেন। যদিও হত্যাকারীদের মদদদাতা হিসেবে সদর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাহমুদুল করিম মাদুর নাম আলোচিত হচ্ছে। তিনি মালেক, আলালদের মামলা থেকে বাঁচাতে তদবির চালাচ্ছেব বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে ঘটনায় জড়িতদের ধরতে সিসিটিভির ফুটেজ, মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য প্রশাসন গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়ে তদন্ত করছে বলে উল্লেখ করেছেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম। ইতোমধ্যে তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে শুক্রবার রাতে জানান তিনি। তখনও মামলা নথিভুক্ত হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) আসরের নামাজের সময় ইফতার অনুষঙ্গ কিনতে চেরাংঘর বাজারে আসেন মোরশেদ আলী। তখনই সেখানে আগে থেকে থাকা সন্ত্রাসীরা তার ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় পৈশাচিকতা চালায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ৮টার দিকে আইসিইউতে তার মৃত্যু ঘটে। সৌদি প্রবাসী মোরশেদ বেড়াতে দেশে এসেছিলেন। তিনি এলাকায় ‘অন্যায়ের প্রতিবাদকারী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দেশে ঘুরতে এলে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলীখেলায় শখের বসে অংশগ্রহণ করতেন বলে তাকে মোরশেদ বলী নামে ডাকা হতো।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews