উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে বাড়ছে চীনের অংশগ্রহণ

প্রথম নিউজ, ঢাকা : বিগত এক দশকে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে চীনের ঋণপ্রবাহ। পদ্মা সেতু রেল লিংক, কর্ণফুলী টানেল, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্ল্যান্টের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে চীনের অর্থায়নে। আরও কয়েকটি বড় প্রকল্প চলমান।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায়, যেখানে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিল দেশটি, সেখানে গত ১২ বছরে দিয়েছে ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে প্রতিশ্রুত ঋণ ১০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ঋণ দেওয়া উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে চীন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে, যা মোট ঋণের ৩১ শতাংশ। এর পরই রয়েছে এডিবি ২৩ শতাংশ এবং মোট ঋণের ১৭ শতাংশ জাপানের কাছ থেকে নেওয়া। এর পরই রাশিয়া ১০ শতাংশ এবং মোট ঋণের ৯ শতাংশ নেওয়া চীনের কাছ থেকে।
গত এক দশকে চীনের প্রতিশ্রুত ঋণ ও ঋণছাড় দুটোই বেড়েছে। ২০১৩ সালে চীনের ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ কোটি ডলার। ছাড় করে ৭ দশমিক ৭ কোটি ডলার। ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতি ছিল ৫ কোটি ডলার, ঋণছাড় করে ৪৭ দশমিক ২৭ কোটি ডলার।

মূলত ২০১৪ সাল থেকে চীনা ঋণের প্রবাহ ও ছাড় বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে চীন কোনো ঋণের প্রতিশ্রুতি না দিলেও ১২ দশমিক ১২ কোটি ডলার ছাড় করে। ২০১৬ সালের প্রতিশ্রুত ঋণ ১৯ দশমিক ৫ কোটি ডলার, ছাড় ১১ দশমিক ৫৭ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে ১২৪ দশমিক ৪৭ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। ওই বছর ছাড় হয় ৬ দশমিক ৩৮ কোটি ডলার।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সমন্বয় সভা হবে। সভায় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার পর চূড়ান্ত হবে। এর আগে কোনো কিছুই ফাইনাল না বা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। মেট্রোরেল ও চার লেনে চীনা ঋণের বিষয়ে আলোচনা চলছে ঘটনা সত্য, তবে চূড়ান্ত নয়।- ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী

২০১৮ সালে প্রতিশ্রুত ঋণ ছিল প্রায় ৩৬২ দশমিক ৪৫ কোটি ডলার, যা এখন পর্যন্ত সর্বাধিক। ওই বছরে ছাড় হয় ৯৭ দশমিক ৮৪ কোটি ডলার বা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে প্রতিশ্রুত ঋণ ৭ দশমিক ২৫ কোটি ডলার হলেও ছাড় হয় ৫১ দশমিক ৫০ কোটি ডলার। ২০২০ সালে চীন ২৪২ দশমিক ৭৪ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ছাড় করে ৬৯ দশমিক ৫৪ কোটি ডলার।

২০২১ সালে কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকলেও ৮৮ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার ছাড় করে দেশটি। ২০২২ সালে প্রতিশ্রুত ঋণ ১১২ দশমিক ৬৯ কোটি ডলার, ছাড় ৯৮ দশমিক ৯৫ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে ২৭ দশমিক ৬২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের বিপরীতে ছাড় ১১৩ দশমিক ২৭ কোটি ডলার।

বাংলাদেশকে এ যাবত মোট ১০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। ছাড় হয়েছে ৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছাড় হওয়ার মধ্যে ১০ কোটি ডলার শুধু অনুদান।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে সম্ভাব্য চুক্তি-সমঝোতা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন। ওই সফরে বেশ কিছু যুগান্তকারী বাণিজ্যিক চুক্তি হবে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানশাওয়ের সৌজন্য সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে আশা করছি, যা দুই দেশের সম্পর্কের মাইলফলক হতে পারে।
জানা যায়, এবারের সফরের বিশেষ দিকটি হবে বাংলাদেশের জন্য চীনের ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪০ কোটি ইউয়ানের বেশি ঋণ। এর মধ্যে বাণিজ্য–সহায়তার আওতায় ৫০০ কোটি ডলার ও বাজেট সহায়তার আওতায় ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় বাংলাদেশকে ঋণ দেবে দেশটি। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যেভাবে টাকা–রুপিতে লেনদেনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় ঢাকা–ইউয়ানে লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।৭ বিলিয়ন ডলার চীনা অর্থায়ন চাওয়া প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সঠিক ফিগার এখনো ঠিক হয়নি, যা কিছু রিপোর্ট হচ্ছে সবই প্রাথমিক বা ধারণাভিত্তিক। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সমন্বয় সভা হবে। সভায় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার পর চূড়ান্ত হবে। এর আগে কোনো কিছুই ফাইনাল না বা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। মেট্রোরেল ও চার লেনে চীনা ঋণের বিষয়ে আলোচনা চলছে ঘটনা সত্য, তবে চূড়ান্ত নয়।’মেট্রোরেল ও ভাঙ্গা-কুয়াকাটা রেলপথ এজেন্ডায় আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘ঘটনা সবই সত্য। এগুলো এজেন্ডায় আছে। এছাড়া আরও অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমরা চূড়ান্ত করারও কেউ না। চূড়ান্ত হবে তখনই যখন চীনে চুক্তি সই হবে। তার আগে এলে কিছু বলাটা সমীচীন হবে না।’

যে প্রকল্পের রিটার্ন তাড়াতাড়ি মিলবে এমন প্রকল্পে চীনা ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা যেন ডিফল্টার না হই। দ্রুত রিটার্ন ভালো হবে এমন প্রকল্পে চীনের ঋণ নিতে হবে। কারণ চীন বড় গ্রেস পিরিয়ড দেবে না।’

‘সুদ ও আসল পরিশোধ করার একটা তাড়া থাকে। সামনে বিপদ আসছে, সবাইকে সাবধান হতে হবে। কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পে সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হবে। যে প্রকল্পে রিটার্ন কম সেই প্রকল্প না নেওয়াই ভালো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এমন প্রকল্প আছে ১০ থেকে ১২ বছর ধরে চলমান অথচ কাজ অর্ধেকও হয়নি। তাহলে এ প্রকল্পে কীভাবে সুফল মিলবে। উল্টো সুদ ও আসল পরিশোধের সময় চলে আসবে। আমাদের সব কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে সুচিন্তিতভাবে।’অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে চীন বাংলাদেশকে যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার ৯৫ শতাংশই এসেছে গত ১২ বছরে। শেষ ছয় বছরে এসেছে ৮৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়েছে দেশটির ঋণছাড়। অর্থাৎ, ২০১৩ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই (এক অঞ্চল, এক পথ) চালুর পর থেকেই বড় আকারে ঋণ দেওয়া শুরু করে।জানা যায়, ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়। এসব প্রকল্পে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। যার মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণের চুক্তি হয়েছে। তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির অপেক্ষায়। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত অর্থছাড়ও বাড়ে।

আমরা যেন ডিফল্টার না হই। দ্রুত রিটার্ন ভালো হবে এমন প্রকল্পে চীনের ঋণ নিতে হবে। কারণ চীন বড় গ্রেস পিরিয়ড দেবে না।- ড. আহসান এইচ মনসুর

ইআরডির তথ্যমতে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের মোট ঋণের স্থিতি ছিল ৬২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীনের অংশ ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের ঋণের স্থিতিতে চীনের অবস্থান চতুর্থ। চীন সরকার সাধারণত দুই ধরনের ঋণ দেয়, এর একটি হলো মার্কিন ডলারে প্রেফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) এবং অপরটি চীনের নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল) বা সরকারিভাবে দেওয়া রেয়াতি ঋণ।অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনা, তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশন পর্যন্ত রেললাইনকে মিটারগেজ থেকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি স্থাপন এবং পৌরসভাগুলোর জন্য পানি সরবরাহ প্রকল্প। ১১ প্রকল্পে চীন থেকে ৫০২ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। যদিও এর একটিরও কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে ভারতও বিনিয়োগ করতে চায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
চীনা ঋণে চলমান ছয় প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রামের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পিজিসিবির আওতায় বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন, ডিপিডিসির আওতায় বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং রাজশাহী ওয়াসার ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ প্রকল্প।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরের তলদেশ দিয়ে তেল সরবরাহের জন্য নির্মিত পাইপলাইন এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম প্রকল্প নামে পরিচিত।এর আগে গত বছরে জুলাইয়ে রাজধানীর আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে চালু হয় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধনাগারের কার্যক্রম। ঋণের বাইরে অনুদানের টাকায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আটটি মৈত্রী সেতু নির্মাণ করেছে চীন।