আইসিটি শিক্ষার ১৩৫৩ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ, কাজের কাজ কিছুই হয়নি
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: নেই কোনো অবকাঠামোগত সুবিধা। এরই মধ্যে মাধ্যমিক স্তর থেকে বাধ্যতামূলক করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি)। উচ্চ মাধ্যমিকে আগে থেকেই ছিল বাধ্যতামূলক। কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই ২০১২ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রমে আইসিটি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই বছরই ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং ২০১৩ সালে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। অথচ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তখনো সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) পদ সৃষ্টিই হয়নি। সরকারি কলেজে ২০১৬ সালে মাত্র ২৫৫টি পদ সৃষ্টি হয়। বেসরকারি কলেজে এ বিষয়ের পদ সৃষ্টি হয় ২০১৮ সালে। এই বিষয়ে মান উন্নয়নের জন্য ২০১৬ সালে নেয়া হয় প্রকল্প। যার বাজেট ধরা হয় এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের জুলাই মাসে। কিন্তু বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হলেও বাস্তবিক অর্থে উপকারে এসেছে যৎসামান্যই।
প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়- শ্রেণি পাঠদান প্রক্রিয়া আধুনিকায়নের মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের উচ্চমানের দক্ষতা নিশ্চিতকরণ, একটি দক্ষ ও বিজ্ঞানমনস্ক টিচার্সপুল তৈরি করা, আইসিটিভিত্তিক জ্ঞান বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা বিজ্ঞানের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সমন্বয় সাধন, শিক্ষাক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের জন্য একটি প্রেরণাদায়ী ধারার সূচনা করা, শিক্ষাক্ষেত্রে টেকসই ও অর্জনযোগ্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা।
প্রকল্প শুরু হয় ২০১৬ সালে। যার আওতাধীন ছিল আইসিটি বিষয়ক ১৩ ধরনের প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন। যাতে প্রশিক্ষণ পান পাঁচ লাখ ২১ হাজার ১১২ জন। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সৃজন করা হয় ৩৬ হাজার ৮৪টি। যাতে থাকার কথা ডেস্কটপ কম্পিউটার, ইউপিএস, পেনড্রাইভ, স্মার্ট টিভি ও রাউটার। প্রকল্পের আওতায় ৬৬৮টি ট্রেনিংরুম ও কনফারেন্স রুম সৃজন করা হয়।
প্রকল্পের অধীনে নায়েম, টিটিসি, এইচএসটিটিআই, বিএমটিটিআই ২১টি করে ১০৫টি মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ কক্ষ নির্মাণ করা হয়। পিআইইউ’তে দুটি করে চারটি, নয়টি আঞ্চলিক অফিসে একটি করে, ৬৪ জেলা শিক্ষা অফিসে একটি করে ও ৪৯০টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে একটি করে মাল্টিমিডিয়া কনফারেন্স কক্ষ নির্মাণ করা হয়। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সৃজনে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে দেয়া হয় একটি করে ডেক্সটপ কম্পিউটার, স্মার্ট টিভি, ইউপিএস, ওয়্যারলেস রাউটার পেনড্রাইভ। মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ কক্ষে দেয়া হয় একটি করে ডেক্সটপ কম্পিউটার, স্মার্ট টিভি, ইউপিএস, ইন্টারনেট মডেম ও স্টেরিও স্পিকার। মাল্টিমিডিয়া কনফারেন্স রুমে দেয়া হয় একটি করে স্মার্ট টিভি ও স্টেরিও স্পিকার।
বিপুল এই অর্থব্যয়ে প্রকল্প আদতে কতোটুকু উপকারে এসেছে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পের আওতায় নানা কথা হলেও শিক্ষক, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও কম্পিউটার ল্যাবের অভাব অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। আবার যেসব উপকরণ দেয়া হয় তার মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। কয়েক বছর না যেতেই অনেক উপকরণ নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সর্বশেষ তথ্যে উঠে এসেছে এই প্রকল্পের দুরবস্থার চিত্র।
সরকারি কলেজে আইসিটি বিষয়ে পদ সৃষ্টি হয়েছে ২৫৫টি। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২৩’র তথ্যানুযায়ী দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২৩ হাজার ৭৮৯টি। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ষষ্ঠ থেকে দশম) ১৮ হাজার ৯৬৮টি এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ এক হাজার ৪৮০টি। কলেজ রয়েছে তিন হাজার ৩৪১টি। মাদ্রাসা রয়েছে নয় হাজার ২৫৯টি। এসবের মধ্যে দেশের প্রায় সাড়ে আট হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। কম্পিউটার ল্যাব তৈরি হয়নি তিন হাজার ৮৫৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ব্যানবেইসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশের তিন হাজার ৮৫৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই। এর মধ্যে বিদ্যালয় দুই হাজার ২২১টি, কলেজ ১৭৬টি ও মাদ্রাসা এক হাজার ৪৬১টি।
রংপুর জেলার একটি স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের আইসিটি প্রশিক্ষণ নেয়া একজন শিক্ষক বলেন, আমি পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। বিজ্ঞানের ক্লাসও নিতে হয়। এই পদে যেহেতু শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হয়নি তাই আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই বিষয়ের জন্য একজন ডেডিকেটেড শিক্ষক প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ডেকে প্রশিক্ষণ না দিয়ে সেই বিষয়ের শিক্ষক প্রয়োজন।
আবার একই জেলার আইসিটি বিষয়ক আরেকজন শিক্ষক বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮৫০ শিক্ষার্থী। একক শিক্ষকের পক্ষে এটা চালানো খুবই দুষ্কর। স্কুলে ৮টি কম্পিউটার রয়েছে। এরমধ্যে চারটি অকেজো। একটি ঠিকমতো কাজ করে না। এখন কোনোরকম কাজ চালানো হচ্ছে।
সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়, মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রবেশের আগেই সকল শিক্ষার্থীকে তথ্যপ্রযুক্তি ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষিত করা হবে। একইসঙ্গে, শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের সঙ্গে কম্পিউটার বিষয় নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়া হবে; যা হবে হাতে-কলমে। আর শেখানোর এ কাজকে সহজ করতে যা করা হবে ভিজ্যুয়াল (অডিও, ভিডিও এবং সচিত্র) মাধ্যমে অর্থাৎ মাল্টি-টাস্কিং সুবিধা-সম্পন্ন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ‘এটুআই’ প্রকল্পের আওতায় এ প্রকল্প চালু করা হয় ২০১১ সালে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের উদ্বোধন করেন। ওই প্রকল্পের আওতায় দেশে ২০ হাজার ৫০০ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় একটি করে কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম, স্ক্রিনসহ মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং সাউন্ড সিস্টেম প্রদান করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালে প্রকল্পটি শেষ হলে ‘আইসিটি ফেজ-২’ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১৬ সালে নেয়া ওই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল দেশের ৩১ হাজার ৩৪০টি ডিজিটাল ক্লাসরুম চালু করা। এ প্রকল্পটি যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালে এবং প্রকল্পটি সরকারি খাতে স্থানান্তর করা হয় ২০২০ সালে। তখন মাউশি’র মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের বাস্তবায়ন ও মনিটরিং এ দায়িত্ব পায়। তবে দেশের ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাল্টিমিডিয়া উপকরণের কোনো অস্তিত্ব বা হদিস পাওয়া যায়নি। এ কার্যক্রমকে সফল করতে ও সক্রিয় রাখতে করা হয়েছিল সমন্বিত মনিটরিং কমিটি। যাতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে। দেশের মাধ্যমিক স্তরের যেসব প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রয়েছে তার থেকেও সাফল্য আনা যাচ্ছে না দক্ষ শিক্ষক না থাকার কারণে। পর্যবেক্ষণ বলছে, মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক ছাড়াও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, ধীরগতির ইন্টারনেট বা ইন্টারনেট না থাকা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সার্বিক দক্ষতার অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য আসছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, আইসিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটির গুরুত্ব বিবেচনায় বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করা প্রয়োজন। আধুনিক প্রজন্ম তৈরি করতে চাইলে হাতে-কলমে যাতে শিক্ষার্থীরা শিখতে পারে সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।