অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার

প্রথম নিউজ, অনলাইন: অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বলেন, গত বছর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি পরিবর্তন ঘটেছে এবং এরপর আমাদের সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আমরা আমাদের জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে, ন্যায়বিচার, সমতা, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে কাজ করছি। আমরা বিশ্বাস করি, এটি আমাদের ভুলগুলো সংশোধন করার, নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার সুযোগ। বৃহস্পতিবার জাপানের টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে অনুষ্ঠিত ৩০তম নিক্কেই ফোরাম ‘ফিউচার অব এশিয়া’র উদ্বোধনী অধিবেশনের মূল বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিশ্ব বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক আস্থা হুমকির মুখে। জাতির মধ্যে, সমাজের অভ্যন্তরে, এমনকি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্ব ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। আমরা এক গভীর অনিশ্চিত সময় পার করছি।
আমরা এমন একটি বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করছি যেখানে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, উত্তেজনা বাড়ছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা সবসময় নিশ্চিত থাকছে না। এশিয়া ও তার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে এবং শান্তি দিন দিন অধরা হয়ে উঠছে। ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট সংঘাত হাজারো মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এক নির্মম রূপ নিয়েছে এবং সামপ্রতিক ভূমিকম্প দেশটির গভীর মানবিক সংকটকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সমপ্রতি আমাদের দুই প্রতিবেশীর মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমরা কোটি কোটি টাকা যুদ্ধের পেছনে ব্যয় করছি, অথচ লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে বা ন্যূনতম চাহিদার জন্য লড়াই করছে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থানে আশাবাদী। ড. ইউনূস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও নতুন নতুন নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ বেড়ে যাওয়ায় মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার ভিত্তি চ্যালেঞ্জের মুখে এবং আর্থিক বৈষম্য সমাজে বেড়েই চলেছে। সামপ্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন বিভাজনের কারণে অসন্তোষ ও অস্থিরতা দেখা গেছে, যা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ডেকে এনেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বহুমুখী অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাজ করছে।
এমনকি মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এশিয়া অনিশ্চয়তার কেন্দ্রস্থলে, একই সঙ্গে সম্ভাবনারও কেন্দ্রে। আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো বিশাল, কিন্তু আমাদের সম্মিলিত শক্তিও বিশাল। এ বাস্তবতায়, আমি বিশ্বাস করি এশিয়ার সামনে একটি সুযোগ, এমনকি একটি দায়িত্ব রয়েছে ভিন্ন পথ দেখানোর: শান্তির, সংলাপের, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের। শুধু সংখ্যাগত নয়, মানুষের কল্যাণ, আস্থা ও আশার উন্নয়ন। আমরা এই চ্যালেঞ্জগুলোর মুখে অসহায় নই। বরং, আমরা ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে আছি। আজকের সিদ্ধান্তগুলো নির্ধারণ করবে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য কেমন পৃথিবী রেখে যাবো। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, কেবল সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য নয়, বরং সমাধান খুঁজে পেতে। এই সমাধানগুলো যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং মানবিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। তিনি বলেন, অর্থ উপার্জন আনন্দের বিষয়। কিন্তু মানুষকে সুখী করা, সেটিই প্রকৃত আনন্দ। আমাদের মনোযোগ সরাতে হবে, ব্যক্তিগত মুনাফা থেকে সমষ্টিগত কল্যাণে। স্বল্পমেয়াদি অর্জন থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্নের দিকে। ‘তিনটি শূন্য’-শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ- এই তত্ত্ব উপস্থাপন করে ড. ইউনূস বলেন, এটি কোনো স্বপ্ন নয়, বরং একটি দিকনির্দেশনা। যেখানে একটি লক্ষ্যে সরকার, ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তি একযোগে কাজ করতে পারে। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি নতুন ধরনের অর্থনীতি, যা প্রতিযোগিতার ওপর নয়, সহানুভূতির ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। শুধু ভোগের ওপর নয়, অন্যের কল্যাণ হয় এমন অর্থনীতি হবে। এখানেই আমাদের ভবিষ্যৎ।
পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ শ্রমিক নেবে জাপান: এদিকে ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ শ্রমিক নিয়োগের কথা জানিয়েছে জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা। বৃহস্পতিবার টোকিওতে ‘বাংলাদেশ সেমিনার অন হিউম্যান রিসোর্সেস’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জাপানে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে। তিনি বলেন, এটা আমার জন্য সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও প্রেরণার দিন। এটি শুধু কাজ করার জন্য নয়, বরং জাপানকে জানারও দ্বার উন্মোচন করবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য। সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টা দুটি সমঝোতা স্মারকের সাক্ষী হন। প্রথমটি বাংলাদেশের ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) ও কাইকম ড্রিম স্ট্রিট (কেডিএস)-এর মধ্যে, যার একটি জাপান-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগ; দ্বিতীয়টি বিএমইটি ও জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-অপারেটিভস (জাপানে ৬৫টির বেশি কোম্পানির একটি ফেডারেশন) এবং জেবিবিআরএ (জাপান বাংলা ব্রিজ রিক্রুটিং এজেন্সি)’র মধ্যে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই অনুষ্ঠানটি একটি দ্বার উন্মোচনের প্রতীক। তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ ১৮ কোটি মানুষের দেশ, যার অর্ধেকই ২৭ বছরের নিচে। তিনি বলেন, সরকারের কাজ হলো তাদের জন্য দরজা খুলে দেয়া। শিজুওকার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন সমবায়ের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থার প্রতিনিধি পরিচালক মিতসুরু মাতসুশিতা বলেন, অনেক জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশিদের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে, এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশি মেধাবীদের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের প্রতিভা লালন করা আমাদের দায়িত্ব। ওয়াতামি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট মিকি ওয়াতানাবে জানান, বাংলাদেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল প্রতিবছর ১৫০০ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়, এবং তারা এই সংখ্যা ৩০০০-এ উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারীরা জাপানের চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। স্বাগত বক্তব্যে জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলী বলেন, ২০৪০ সালের মধ্যে জাপানে শ্রমিক সংকট এক কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারে।