১৫ বছরে মসিকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ৫০ ফ্ল্যাটের মালিক, দুদকে অভিযোগ  

১৫ বছরে মসিকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ৫০ ফ্ল্যাটের মালিক, দুদকে অভিযোগ  

প্রথম নিউজ, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি:  ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর ২০০৫ সালে মাষ্টারোলে অফিস সহকারি পদে চাকরিতে যোগদান করে নামে-বেনামে অর্ধশত ফ্ল্যাট মালিক হয়েছেন। গড়েছেন নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ ও বিত্তবৈভব। আর এসবই হয়েছে বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে-বাইরে প্রকাশ্য গুঞ্জণ থাকলেও বিগত সরকারের ক্ষমতার প্রভাবে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তবে বর্তমানে দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সাধারণ মহলে চাউর হয়ে উঠেছে এই বিত্ত বৈভবের নানা গুঞ্জণ।  

সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মেয়র বর্তমানে একাধিক মামলার পলাতক আসামি ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: ইকরামুল হক টিটুর ঘনিষ্টভাজন। তাঁর হাত ধরেই তিনি অফিস সহকারি থেকে মাষ্টারোলে অফিস সহকারি পদে চাকরিতে যোগদান করে বর্তমানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আর এ সুযোগে মেয়রের ঘনিষ্টভাজন হিসাবে নগরজুড়ে তার পরিচিতি থাকার কারণে কর্পোরেশনের অটো-রিক্সার লাইসেন্স থেকে শুরু করে বহুতল ভবন অনুমোদনেও তার একছত্র আধিপত্য ছিল প্রতিষ্ঠানটির সকল দপ্তরে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের অভিযোগ, বর্তমানে ময়মনসিংহ নগরীর প্রায় ৪ হাজার বহুতল ভবনের অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে ভবন নির্মান নীতিমালা উপেক্ষা করে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কমপক্ষে দেড় শতাধিক ভবনের অনুমোদন পাইয়ে দিয়েছেন এই প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আর এ সুযোগে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি নগদ টাকা ও অসংখ্য ভবনের অংশিদারিত্ব এবং ফ্ল্যাট। এর মধ্যে নগরীর টাউন হল মোড় এলাকায় ৪৮ জনের যৌথ মালিকায় গড়ে উঠা টাউন প্যালেস নামক ১৮ তলা ভবনে আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের রয়েছে ৯টি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে ২টি নিজ নামে, স্ত্রী সুরাইয়ার নামে ১টি। বাকি ৬টি এখনো রেজিস্ট্রি হয়নি। তবে এই ৬টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২টি ফ্ল্যাট একত্র করে মার্বেল পাথরে অত্যাধুনিক সামগ্রী ব্যবহার করে বসবাসের উপযোগীকরণের নির্মাণ কাজ চলমান। নগরীর ডিবি রোড এলাকায় ১৪ তলা সিটি ভিউ টাওয়ারে ৪টি প্ল্যাটের মালিক আমিনুল ইসলাম। এর মধ্যে ২টি স্ত্রী সুরাইয়া, ১টি বোন রোকেয়ার নামে এবং অপরটি নিজ নামে। তবে এসব ফ্ল্যাট সম্প্রতি অতিগোপনে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে সূত্রের দাবি। 

নগরীর নতুন বাজারস্থ ১৮ তলা গ্রীণ সিটি ভবনে আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর ৯টি ফ্ল্যাটের মালিক। তবে বর্তমানে স্ত্রী সুরাইয়ার নামে ৩টি, শ্যালিকা শামীমার নামে ৩টি ফ্ল্যাট বহাল আছে। বাকি ৩টি এক ইউপি চেয়ারম্যানসহ অন্যত্র বিক্রি করা হয়েছে। ব্রাহ্মপল্লী এলাকার ১৬ তলা স্টার ভিউ প্যালেস নামক ভবনে স্ত্রী সুরাইয়ার নামে রয়েছে ১টি ফ্ল্যাট। নামে-বেনামে আরও রয়েছে আরও ৭টি। আঠারবাড়ী হাসনাইন টাওয়ারে বর্তমানে আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের রয়েছে ৩টি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে ১টি লিটন নামের একজনকে এবং অপর ১টি দিয়েছেন মেয়ের গৃহশিক্ষিকাকে। এছাড়াও এই ভবনে তাঁর রয়েছে বাণিজ্যিক অংশিদারিত্ব। নগরীর নতুন বাজার সংলগ্ন সাহেব আলী রোডস্থ কুইন সিটি ভবনে ৩টি ফ্ল্যাট রয়েছে জাহাঙ্গীরের। মাত্র ৪ শতক জমিতে ভবন নির্মাণ বিধিমালা লঙ্গন ১৩ তলা ভবনের অনুমোদন পাইয়ে দিয়ে নামমাত্র টাকায় এই ৩টি ফ্ল্যাট ভাগিয়ে নেন তিনি। 

নগরীর চরপাড়া এলাকায় ৩০ শতক জমিতে ৯ জনের যৌথ মালিকানায় স্কাইটাচ প্যালেস নামক একটি ভবন নির্মাণ অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এতে মালিকানা দলিলে স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার একজন অংশিদার। ইতোমধ্যে সুরাইয়া আক্তার ত্রিশাল উপজেলার আতিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ১টি ফ্ল্যাট লিখে দিয়েছেন। নগরীর বাইপাস ময়নার মোড় এলাকায় ৩০ শতক জমি নিজ নামে ক্রয় করেন জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে প্লট আকারে উচ্চ মূল্যে তা বিক্রি করা হয়। এছাড়াও নগরীর বিপিণ পার্কের উল্টো দিকে নির্মিত বহুতল ভবনে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে নগরজুড়ে আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের মালিকায় প্রায় ৫০টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের।

সূত্রটি আরও জানায়, নগরীর ভবনগুলোর নকশার লে-আউট প্লান অনুমোদনপত্রগুলো খতিয়ে দেখলেই প্রভাব বিস্তার করে জাহাঙ্গীরের ভবন অনুমোদন পাইয়ে দেওয়ার প্রমাণ মিলবে। কারণ আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের সুপারিশকৃত প্রতিটি ভবনের নকশার লে-আউট প্লান অনুমোদনপত্রে তাঁর স্বাক্ষর রয়েছে। যাতে করে মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা ফাইল দেখেই বুঝতে পারেন এটি জাহাঙ্গীরের সুপারিশকৃত ফাইল। নগরীর মোহাম্মদ আলী ও জিলা স্কুল রোড এলাকার আব্দুল বাতেন খান গংয়ের একটি ভবনের নকশার লে-আউট প্লান অনুমোদনপত্রে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর উপজেলার চরঈশ্বরদিয়া এলাকার নিজের গ্রামের বাড়ীতে আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বিশাল জায়গাজুড়ে নির্মাণ করেছেন দৃষ্টিনন্দন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ী। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি নানা ব্যাংকে নামে-বেনামে তার রয়েছে এফডিআরসহ নগদ অর্থ।  তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন, এসব অভিযোগ ঠিক না। আমার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার আত্মীয় স্বজন রয়েছে, তাদেরও ফ্ল্যাট আছে।

এদিকে চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মসিকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর প্রায় এক হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন মর্মে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ করেছেন নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আলকাছ উদ্দিন নামক এক ব্যক্তি। ওই অভিযোগপত্রে তিনি দাবি করেন, দেশের পরবর্তিত প্রেক্ষাপটে অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব বিত্ত-বৈভরের বেশির ভাগ ফ্ল্যাট ও জমি আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর তাঁর স্বজনদের কাছে অতিকৌশলে হস্থান্তর করেছেন। তবে তদন্ত করলেই এসবের প্রমাণ মিলবে বলেও দাবি করেন এই অভিযোগকারী।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক ময়মনসিংহ কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মো: বুলু মিয়া বলেন, এই অভিযোগ এাখনো আমরা হাতে পাইনি। দুদক দপ্তর থেকে তদন্তের অনুমতি মিললে এটি আমাদের অফিসে আসবে। তখন এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

তবে এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করেও ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো: মোখতার আহমেদের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানের সচিব সুমনা মজিদ এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি ঢাকায় একটি মিটিংয়ে আছি, অন্য সময় অফিসে এসে কথা বলেন।