হোটেল-রেস্তোরাঁ শিল্প ঘোষণার পরও বিধিমালা নিয়ে গড়িমসি

ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শেষ দিকে রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। সে বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২-এ রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে ঘোষণার প্রায় এক বছর (১১ মাস) পেরিয়ে গেলেও এখনো হয়নি এ শিল্পের বিধিমালা।

হোটেল-রেস্তোরাঁ শিল্প ঘোষণার পরও বিধিমালা নিয়ে গড়িমসি

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শেষ দিকে রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। সে বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২-এ রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে ঘোষণার প্রায় এক বছর (১১ মাস) পেরিয়ে গেলেও এখনো হয়নি এ শিল্পের বিধিমালা। এমনকি রেস্তোরাঁ শিল্পের অংশীজনদের নিয়ে এখনো কোনো বৈঠকও করেনি শিল্প মন্ত্রণালয়। ফলে শিল্পঘোষিত খাতটি অবহেলিতই রয়ে গেছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, আমরা শুধু ঘোষণা শুনেছি যে এ খাত শিল্প হয়েছে। তবে গত প্রায় এক বছরেও শিল্পটির বিধিমালা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি কোনো মালিক বা সমিতির সঙ্গে একটি বৈঠকও হয়নি। ফলে খাতটি এখনো শুধু শিল্প ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। তিনি বলেন, বিগত দিনে আমরা শিল্প সচিবের সঙ্গে মিটিং করতে গিয়েছি। কিন্তু সেটা বাতিল করা হয়েছে। পরে মিটিংয়ের জন্য আমাদের কোনো সময় দেওয়া হয়নি, কেউ আমাদের সঙ্গে বসেওনি। আমরা দ্রুত শিল্পের নীতিমালা বাস্তবায়ন চাচ্ছি। এ নিয়ে সরকারের গড়িমসি রয়েছে। এতে দিন শেষে শিল্পটিরই ক্ষতি হচ্ছে।

রেস্তেরাঁকে শিল্প ঘোষণা করার সময় খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন, শিল্প হিসেবে ঘোষণা করায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিদ্যমান অনেক সমস্যা সমাধান হবে। বর্তমানে এ শিল্প যে অবস্থায় রয়েছে, আগামী ১০ বছরে তা আরও তিনগুণ বাড়বে। বিশ্বজুড়ে এখন রেস্তোরাঁ শিল্প সম্ভাবনাময় খাত। ভবিষ্যতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মত এ অঞ্চলের মানুষও রেস্তোরাঁনির্ভর জীবনযাপন করবে। সেভাবেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও অভ্যাস গড়ে উঠছে।

ইমরান হাসান বলেন, সরকার রেস্তোরাঁ শিল্পে সুনজর দিলে আগামীতে এ খাত থেকে বাংলাদেশ প্রচুর সংখ্যক প্রশিক্ষিত কর্মী বিদেশে পাঠাতে পারবে। সেটি দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। আবার বিদেশফেরত অনেক প্রবাসীও এখন এ খাতে জড়িয়ে পড়ছেন, ব্যাক টু ব্যাক শিল্পের মত। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে রেস্তোরাঁ শিল্প থেকে সেবাখাতে বিশ্বব্যাপী দুই কোটি দক্ষ কর্মী তথা বিপুল জনশক্তি রপ্তানি সম্ভব।

গত এক দশকে দেশের রেস্তোরাঁ শিল্পে এসেছে বড় পরিবর্তন। জিডিপির পাশাপাশি প্রতিবছর বাড়ছে কর্মসংস্থান। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে ছোট-বড় প্রায় সব শহরে গড়ে উঠেছে উন্নতমানের রেস্তোরাঁ। উন্নত বিশ্বের আদলে অনেক চেইন রেস্তোরাঁও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এতে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও রুচিতে পরিবর্তন আসছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের। এরই মধ্যে সরকার রেস্তোরাঁকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়ায় উচ্ছ্বসিত এ খাতের ব্যবসায়ীরা। উন্নত বিশ্বের মত বাংলাদেশের রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে একটি মানসম্পন্ন জায়গায় নিতে স্বপ্ন বুনছেন তারা।

শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেস্তোরাঁ খাতের প্রসারে এ শিল্পে এখন পর্যন্ত বিপুল কর্মসংস্থানও হয়েছে। দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি এ শিল্প কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পর্যটনসহ নানা খাতের অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখছে। সরকার শিল্প ঘোষণা করায় আগামী এক দশকে দেশের রেস্তোরাঁ খাতের কয়েকগুণ প্রসার হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নীতি, আইন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালীন রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প ঘোষণা করেছিলেন শেখ ফয়েজুল আমীন। তখন তিনিই এ বিষয়টি দেখভাল করেন। বর্তমানে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) হিসেবে নিয়োজিত। জানতে চাইলে তিনি  বলেন, রেস্তোরাঁকে শিল্পের মর্যাদা দিয়েছি। এরপরও এ খাতের ব্যবসায়ীদের কোনো পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করতে হবে। লিখিতভাবে জানাতে হবে। মন্ত্রণালয় সে অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেবে। বিধিমালা নিয়ে তারা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কোনো আলাপ করেছে বলে আমার জানা নেই।

রেস্তোরাঁ শিল্পের বিষয়টি এখন দেখভাল করছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (নীতি) মো. সলিম উল্লাহ। এ শিল্পের বিধিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি  বলেন, শিল্প ঘোষণা হলেও কখনো কখনো পলিসি তৈরি করা হয়, তবে এ নিয়ে এখনো কোনো বিধিমালা তৈরি হয়নি। মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকরা চাইলে সেটা হবে। এ বিষয়ে শিগগির বৈঠক হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হোটেল ও রেস্তোরাঁর সার্ভে-২০২১ এর তথ্য বলছে, গত ১১ বছরে দেশে হোটেল ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় এক লাখ ৬১ হাজার। ২০০৯-১০ সালে যেখানে দেশে রেস্তোরাঁর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার, তা গত বছর বেড়ে ৪ লাখ ৩৬ হাজার হয়েছে। ওই সার্ভেতে আরও বলা হয়, এ সময়ে এ শিল্পে কর্মরত মানুষের সংখ্যাও হয়েছে দ্বিগুণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর্মরত ছিলেন ৯ লাখ ৪ হাজার মানুষ, যা গত বছর (২০২০ সালে) বেড়ে ২০ লাখ ৭২ হাজার হয়েছে। ফলে এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে মূল্য সংযোজন বেড়েছে আট গুণ। এক দশক আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে মূল্য সংযোজন হয়েছিল মাত্র ১১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয়েছে ৮৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।

প্রায় এক বছর আগে সরকারের শিল্প ঘোষণা নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন রেস্তোরাঁ মালিকের সঙ্গে। তারা জানান, অপেক্ষাকৃত কম পুঁজিতে বাংলাদেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা লাভজনক। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এ শিল্পের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। সে কারণে ঢাকা ছাড়াও দেশের প্রায় সব জেলা-উপজেলায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন হোটেল-রেস্তোরাঁ গড়ে উঠছে। একই সঙ্গে নিত্যনতুন খাবারের প্রসারও এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে। দেশের অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে এ শিল্পের। তবে শিল্প ঘোষণার পরও বিধিমালা না হওয়ায় থমকে আছে হোটেল-রেস্তোরাঁর মানোন্নয়ন।

রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসা শিল্পের মর্যাদা না পাওয়ায় বেশ সমস্যা হতে। বিশেষত, ব্যবসায়ীদের সরকারি সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে চড়া মূল্য দিতে হতো। প্রতিযোগিতার বাজারে অনেকে পিছিয়ে পড়তেন। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন, তারা প্রতিনিয়ত চড়া সুদ গুনেছেন। ঋণ পরিশোধ সব সময়ই আর্থিক চাপ, যে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান টিকতে পারেনি। শিল্প না হওয়ায় এতদিন রেস্তোরাঁ ব্যবসা দেশের পুঁজিবাজার, বিশেষত সম্ভাবনাময় বন্ড মার্কেট গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও কোনো ভূমিকা নেয়নি। কিন্তু শিল্প ঘোষণা হওয়ার পরও সেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

আল-কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টের কর্ণধার ফিরোজ আলম সুমন  বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসা নির্ঞ্ঝাট নয়। বড় বড় রেস্তোরাঁয় এখন বিনিয়োগও প্রচুর। তারপরও এতদিন এ ব্যবসার কোনো স্বীকৃতি ছিল না। কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহায়তাও মেলেনি। সেজন্য এ খাতের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের প্রায়ই নানা সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছেন অনেক তরুণের উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, এ খাত শিল্প ঘোষিত হওয়ায় এখন অনেক সমস্যা কেটে যাবে। বড় বিনিয়োগ আসবে। কয়েক বছরের মধ্যে এ খাত পাল্টে যাবে। যেসব তরুণ উদ্যোক্তা রেস্তোরাঁগুলোতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে যাচ্ছেন তারা আরও উদ্যমী হবেন। ব্যাংকগুলো সব ব্যবসায় ঋণ দিলেও রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ঋণ দিতে চাইতো না। সহজ শর্তে ঋণ পেলে তরুণরা আরও ভালো করবেন। সেজন্য দ্রুত শিল্পের বিধিমালা বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ওসমান গণি বলেন, আমরা চাই, সরকার যে আন্তরিকতা নিয়ে এ খাতটি শিল্প ঘোষণা করেছে, সেরকমভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে দ্রুত একটি ব্যবসাবান্ধব বিধি বা প্রবিধি প্রণয়ন করবে। যেন এ শিল্পের অবদান দ্রুততম সময়ে অর্থনীতিতে অন্যতম সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে।