Ad0111

শেয়ারবাজারে বেপরোয়া কারসাজি চক্র, নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা

এই চক্র একের পর এক কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ।

শেয়ারবাজারে বেপরোয়া কারসাজি চক্র, নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশের শেয়ারবাজারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কারসাজি চক্র। এই চক্র একের পর এক কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। তবে এই চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে কারসাজির মাধ্যমে এই দাম বাড়ানো হয়েছে। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তথ্য প্রচার করে শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই কারসাজি বন্ধ করতে পারছে না। কারসাজি বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিএসইসি কারসাজি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি।

বর্তমানে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে আলোচিত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। মাত্র ১৭ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ১৭ কার্যদিবসে ১০০ টাকায় লাভ ১৮০ টাকা। গত ২৩ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৪৯ টাকা ৪০ পয়সা। যা টানা বেড়ে ১৭ জানুয়ারি লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ১৩৮ টাকা ৩০ পয়সায়।

কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার প্রবণতা শুরু হয় ২০২১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে। গত ২৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি এই আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে। ১৯৭৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারের দাম এর আগে কখনো এমন উচ্চতায় পৌঁছায়নি।

শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়া আরেক কোম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এই জীবন বিমা কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১২ কার্যদিবসে বেড়েছে ১১৫ শতাংশ। গত ২৯ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৫০ টাকা ১০ পয়সা। সেখান থেকে বেড়ে প্রতিটি শেয়ারের দাম ১০৭ টাকা ৭০ পয়সায় উঠেছে।

শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটিতে নজিরবিহীন লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদ থেকে হেমায়েত উল্লাহকে বহিষ্কার করেছে।

শুধু এই কোম্পানি নয়, সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। মূলত কারসাজি চক্রের মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার কৌশলের কারণেই এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। আর শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ এসব কোম্পানির শেয়ার কিনছেন। এদের কেউ লাভের মুখ দেখছেন, আবার কেউ বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছেন।

সম্প্রতি যেসব কোম্পানির শেয়ারের দামে বড় ধরনের উত্থান-পতন হয়েছে তার মধ্যে লাভেলো আইসক্রিম, ফরচুন সুজ, ওয়ান ব্যাংক, মেঘনা লাইফ, তিতাস গ্যাস, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, মালেক স্পিনিং, সোনালী পেপার, কেয়া কসমেটিকস, আরএকে সিরামিকসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ানোর পিছনে কয়েকজন বিনিয়োগকারীর নাম ব্রোকারেজ হাউসের বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে ঘুরছে। এর আগে এই বিনিয়োগকারীরাই ২০১৯ ও ২০২০ সালে বেশ কয়েকটি বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে বড় অংকের মুনাফা হাতিয় নেয়।

শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর আগে আলোচিত এসব বিনিয়োগকারীরা প্রথমে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির উল্লেখযোগ্য শেয়ার কৌশলে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেন। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর শুরু হয় শেয়ারের দাম বাড়ার প্রবণতা। হু হু করে দাম বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো কোম্পানির শেয়ার কিনতে থাকেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার মধ্যেই সটকে পড়েন দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখা আলোচিত বিনিয়োগকারীরা। ফলে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পরেই আবার অস্বাভাবিক দরপতনের ঘটনাও ঘটে।

২০২১ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ব্যাংকটির শেয়ারের এই দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখেন বর্তমানে শেয়ারবাজারের সবচেয়ে আলোচিত এক বিনিয়োগকারী। গত ৮ নভেম্বর ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম ছিল ১২ টাকা ৪০ পয়সা, এখান থেকে বাড়তে বাড়তে ৩০ নভেম্বর ২০ টাকা ১০ পয়সায় ওঠে প্রতিটি শেয়ারের দাম। এরপর ৭ ডিসেম্বর থেকে আলোচিত ওই বিনিয়োগকারী ব্যাংকটির বিপুল অংকের শেয়ার বিক্রি করা শুরু করেন। এতে দেখতে দেখতে ১৯ ডিসেম্বর ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১৩ টাকা ৮০ পয়সায় নেমে যায়। ফলে ১৮-২০ টাকার মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার কেনা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বড় অংকের লোকসানের মধ্যে পড়েন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, ‘বাজারে এখন কোন কোম্পানির শেয়ার, কে দাম বাড়াচ্ছে তা ওপেন সিক্রেট। ফলে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়াই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ এসব শেয়ার কিনছেন। এদের মধ্যে কেউ লাভের মুখ দেখছেন, আবার কেউ লোকসান গুনছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেভাবে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে, তা বাজারের স্বাভাবিকতা নষ্ট করছে। শেয়ারবাজার বিনিয়োগের বদলে এখন আইটেমের বাজারে পরিণত হয়েছে। আলোচিত বিনিয়োগকারীরা যে কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, তার দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাজারের ভিত দুর্বল হয়ে পড়বে।’

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলন, ‘১৫ দিন, এক মাসের মধ্যে শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যাওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা না। আমি বলবো, এটা অস্বাভাবিক। এর পিছনে কারসাজি থাকলে থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ওই ফাঁদে পা দেয় কেন?’

তিনি বলেন, ‘বহুবার বলা হয়েছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনার আগে সার্বিক বিষয় ভালো করে পর্যালোচনা করে কেনা উচিত। একজন কিনলো আর তার পিছনে একশো জন বিনিয়োগকারী কেনা শুরু করলো, আর দাম বেড়ে গেলো। এটা তো বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ না। তবে শেয়ারের দাম বাড়ার পিছনে কারসাজি আছে কি না তা বিএসইসির দেখা উচিত এবং কারসাজির কোনো প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

বিএসইসির সাবেক আরেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘বোঝাই যাচ্ছে, ম্যানুপুলেট (কারসাজি) করেই দাম বাড়ানো হচ্ছে। ম্যানুপুলেশন রেগুলেটররা (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) বন্ধ করতে পারছে না। বন্ধ করতে না পারার জন্য রেগুলেটররা দায়ী, ইনভেস্টররাও (বিনিয়োগকারীরা) ঠিক একইভাবে দায়ী। ভালো সংবাদকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে ম্যানুপুলেটররা শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি কোনো একক কোম্পানির নাম বলছি না, সার্বিক বাজারেই এটা হচ্ছে (কোম্পানির ভালো সংবাদ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো)। আমি বলবো, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইনঅ্যাকটিভ (নিষ্ক্রিয়)। ম্যানুপুলেশন বন্ধে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি।’

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘সিকিউরিটিজের দাম নির্ভর করে ডিমান্ড ও সাপ্লাইয়ের ওপর। কোন কোম্পানির শেয়ার দাম কত হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ না। তবে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না তা আমাদের সার্ভেইলেন্স টিম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে। সন্দেহজনক কিছু থাকলে তা কমিশন তদন্ত করে। তদন্তে ইনসাইডার ট্রেডিং বা অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসলে কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news