ভারত- চীনের প্রতিযোগিতা মালদ্বীপ নিয়ে

ভারত ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বৃহত্তর মেল কানেকটিভিটি প্রজেক্ট (GMCP) শুরু করেছিল, যা মালদ্বীপের বৃহত্তম পরিকাঠামো প্রকল্প। 

ভারত- চীনের প্রতিযোগিতা মালদ্বীপ নিয়ে

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: ভারত মালদ্বীপে তার প্রভাব বজায় রেখেছে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহের অধীনে, যিনি ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসেন। সোলিহ প্রশাসন "ভারত-প্রথম" নীতি অনুসরণ করেছিল এবং ভারত মালদ্বীপের বিভিন্ন প্রকল্পে ২.৭১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে আছে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রেডিট লাইনের অধীনে হুলহুমালেতে ১০০ শয্যার একটি অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল এবং মালদ্বীপে ২২,০০০ আসনবিশিষ্ট একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। AICIS রিপোর্ট অনুযায়ী, কোভিড ১৯ মহামারী চলাকালীন মালদ্বীপে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন উপহার দিয়ে ভারত নিজের সদিচ্ছার পরিচয় দিয়েছিলো। বেইজিং ভ্যাকসিন কূটনীতিতে পিছিয়ে ছিল, কারণ প্রথম চীনা ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মার্চের শেষে মালদ্বীপে পৌঁছেছিল। ভারত সেইসময়ে ভ্যাকসিনের শীর্ষস্থানীয় উৎপাদক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। ভারত ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বৃহত্তর মেল কানেকটিভিটি প্রজেক্ট (GMCP) শুরু করেছিল, যা মালদ্বীপের বৃহত্তম পরিকাঠামো প্রকল্প। 

AICIS জানিয়েছে, এই প্রকল্পের অধীনে মালে এবং পার্শ্ববর্তী দ্বীপের ভিলিংলি, গুলহিফালহু এবং থিলাফুশির মধ্যে একটি ৬.৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু সম্পৃক্ত রয়েছে, যার জন্য ব্যয় বরাদ্দ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। হানিমাধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মালদ্বীপ সফরের সময় উপস্থিত ছিলেন। ১৩৬.৬ মিলিয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন এক্সিম ব্যাংক মারফত ক্রেডিট লাইনের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল এবং বিমানবন্দরের উন্নয়ন ভারতীয় কোম্পানি জেএমসি প্রজেক্টস লিমিটেড দ্বারা সম্পাদিত হচ্ছে।  ১ মে ২০২৩-এ, ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং তার মালদ্বীপের প্রতিপক্ষ মারিয়া আহমেদ দিদির আমন্ত্রণে ৩ দিনের সরকারি সফরে মালদ্বীপে এসেছিলেন, যেখানে তারা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করার জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেন। ভারত ২ মে ২০২৩-এ একটি অনুষ্ঠানে মালদ্বীপের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (MNDF) অ্যাসল্ট ল্যান্ডিং ক্রাফট সহ একটি টহলদারি জাহাজ হস্তান্তর করেছে।

২০১২সালে, মালদ্বীপে রাজনৈতিক সংকট উদ্ভুত হবার পর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, নাশিদকে ভারতপন্থী বলে মনে করা হয়েছিল। তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওয়াহেদ যাকে চীনের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসাবে দেখা হয়েছিল, তিনি তখন ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। এশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর চায়না অ্যান্ড আইওআর স্টাডিজ (AICIS) লিখেছে, মালদ্বীপে চীনের প্রভাব ২০১৩এবং২০১৮ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। চীন সরকার সেইসময়ে দেশের প্রধান অবকাঠামো প্রকল্পগুলিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ভারত মহাসাগরের একটি ছোট দ্বীপ দেশ মালদ্বীপ গত এক দশকে চীনের জন্য ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। মালদ্বীপে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব ২০১৩ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ এটি বিনিয়োগ এবং পর্যটনের একটি প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। চীন মালদ্বীপকে অনুদান ও ঋণের আকারে আর্থিক সহায়তাও দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের (২০১৩-১৮) সময় মালদ্বীপকে চীন ঋণের ফাঁদে ফেলেছিল, ২০১৪ সালে BRI-তে মালদ্বীপের যোগদানের অঙ্গ হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং মালদ্বীপে রাষ্ট্রীয় সফর করেছিলেন।

মালদ্বীপও এই সময়ের মধ্যে অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছিল, মালদ্বীপের কাছে চীনা ঋণ ৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। হুলহুমলে দ্বীপে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিএসসিইসি) দ্বারা নির্মিত ৭,০০০ হাউজিং ইউনিটের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি রাস্তা এবং সেতু সহ ভ্যানিটি অবকাঠামো প্রকল্পও ছিল। বেশিরভাগ অবকাঠামো প্রকল্পে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান না দিয়ে চীনা ইঞ্জিনিয়ার এবং বিদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি ছিল মালদ্বীপের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি নতুন রানওয়ে নির্মাণ, যা চীনা সরকার দ্বারা অর্থায়ন করা হয়েছিল এবং একটি চীনা কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। প্রকল্পটি বিতর্কিত ছিল, কারণ সমালোচকদের যুক্তি ছিল যে মালদ্বীপ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়তে পারে।

মালদ্বীপও ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর চীনের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্বাক্ষর করেছে, যা তাদের সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এই চুক্তিটি চীন এবং মালদ্বীপের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্বীপরাষ্ট্রে বৃহত্তর চীনা বিনিয়োগকে সহজতর করবে বলেও আশা করা হয়েছিল। চুক্তিটি নিয়ে বিরোধীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দাবি করেছিল যে এর জেরে মালদ্বীপ চীনের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে। তারা চুক্তির অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি অনুমোদনের সময়ে তাড়াহুড়ো করেছে বলে অভিযোগ। মালদ্বীপের অনেক সমালোচক বলেছেন যে এই চুক্তির ফলে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের শুল্কের ক্ষতি হবে। ২০২০সালে মালদ্বীপের অর্থ মন্ত্রীও দাবি করেছিলেন যে এফটিএ অগ্রহণযোগ্য এবং স্বাক্ষর করা উচিত ছিল না।

২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মালদ্বীপের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপও পাল্টেছে, ক্ষমতাসীন মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি) অভ্যন্তরীণ বিভাজনের মুখোমুখি হয়েছে যা তার ভোটকে ভাগ করতে পারে। এমডিপি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের অধীনে "ভারত-প্রথম" নীতি অনুসরণ করেছে। নাশিদ সোলিহের প্রশাসনে দুর্নীতি এবং অপশাসনের অভিযোগ করেছেন এবং এমডিপি বিভক্ত হয়ে যেতে পারে বলে উদ্বেগ রয়েছে। এটি বিরোধীদের এডভ্যান্টেজ দিতে পারে, কিন্তু মালদ্বীপের প্রগ্রেসিভ পার্টির (পিপিএম) সামনে অন্য চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন বর্তমানে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য অযোগ্য।মালদ্বীপ যখন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে নির্বাচনী জালিয়াতির বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও উদ্বেগের কারণ। প্রেসিডেন্ট সোলিহের অধীনে মিডিয়ার ক্র্যাকডাউন অব্যাহত ঠিক যেমন তার পূর্বসূরি ইয়ামিনের অধীনে হয়েছিল।

ছোট দলগুলো তাদের প্রার্থী দিচ্ছে, নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। ফলাফল ঘোষণার ৩০ দিনের জন্য ব্যালট পেপার সংরক্ষণ এবং জালিয়াতি রোধে সাধারণ নির্বাচন আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৩ সালের নির্বাচন মালদ্বীপের বৈদেশিক নীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে, কারণ ভারত ও চীন ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপে কৌশলগত প্রভাবের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। সোলিহ-নাশিদ জোট ক্ষমতায় এলে তা ভারতের পক্ষে মঙ্গলজনক। অন্যদিকে চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্যগুলিকে অগ্রসর করতে মালদ্বীপে দ্বিতীয় পিপিএম প্রশাসনের আশা করছে। সূত্র : দা প্রিন্ট