বন্ধুকে ‘ব্যবহার’ করে পি কে হালদারের আরও ৩০০ কোটি লুটপাট: শিগগিরই মামলা
রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের এমডি থাকার সময়ে তার বন্ধু ও ন্যাম কর্পোরেশনের মালিক আব্দুল আলীম চৌধুরীর সঙ্গে মিলেমিশে কাগুজে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছেন পি কে হালদার।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন কৌশলে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে তিনশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার সিন্ডিকেট। অবাক করা বিষয় হচ্ছে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে এমনও ঋণ দেওয়া হয়েছে, যার আবেদন ও কাগজপত্র পরে তৈরি করা হয়েছে। আর এসব কাজের জন্য এক বন্ধুকে ‘ব্যবহার’ করেছেন পি কে হালদার।
জানা গেছে, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের এমডি থাকার সময়ে তার বন্ধু ও ন্যাম কর্পোরেশনের মালিক আব্দুল আলীম চৌধুরীর সঙ্গে মিলেমিশে কাগুজে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছেন পি কে হালদার। যেখানে অংশ নিয়েছেন পি কে সিন্ডিকেটের অন্যান্য সহযোগীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কাগজে কলমে ন্যাম কর্পোরেশনের মালিক আব্দুল আলিম চৌধুরী। প্রকৃত অর্থে এ প্রতিষ্ঠানের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তারপরও কোনো ঋণ আবেদন ছাড়াই পি কে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকার সময়ে বন্ধু ও জে কে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ২০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দিয়েছেন। রেকর্ডপত্রে দুদক দেখতে পায় ঋণ আবেদন হয়েছিল ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। কিন্তু ঋণ অনুমোদন করা হয় ওই বছরের ৩ এপ্রিল। ঋণ আগে ছাড় করার পর কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছিল। এভাবে পি কে হালদার তার বন্ধু আব্দুল আলীম চৌধুরীকে দিয়ে বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করেন। শিগগিরই অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান এ সংক্রান্ত মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ শর্তে বলেন, আত্মসাৎ করা ঋণের বেশির ভাগেরই মর্টগেজ ছিল না, থাকলেও তার পরিমাণ খুবই নগণ্য, কিছু ক্ষেত্রে মর্টগেজ নেওয়ার কথা থাকলেও পরে মর্টগেজ নেওয়া হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় ঋণ ছাড় করার পরে আবেদন ও কাগজপত্র তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেছে। অথচ ঋণ হিসাব থেকে সব টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে মামলা দায়ের করা হতে পারে। পি কে হালদারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, তার বিষয়ে আপনারা অবগত আছেন। যেহেতু সে দেশের বাইরে গ্রেপ্তার রয়েছে, দুদক আইন ও বিধি অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ঋণ আত্মসাতের বিবরণে যা পাওয়া যায়: বাংলাদেশ ব্যাংকের দশটি চেক ব্যবহার করে ২০১৭ সালের ২ আগস্ট জে কে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ইরফান আহমেদ খানের নামে ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের স্টেশন রোড শাখা থেকে প্রায় ২৩ কোটি টাকা উত্তোলন ও আত্মসাৎ করে পি কে হালদার সিন্ডিকেট। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক একেএম শহীদ রেজা’র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ফ্যাশন প্লাস ও পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেডের নামে ২০১৭ সালে ৭ কোটি টাকা সরিয়ে নেয় এ সিন্ডিকেট। সুব্রত দাস ও শুভ্রা রাণী ঘোষের মালিকানাধীন অ্যান্ড বি ট্রেডিংয়ের নামে আইএফআইসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে ২০১৭ সালে নেওয়া হয় ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
একই প্রক্রিয়ায় আনান কেমিক্যালের ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ নিলেও একটি টাকাও ব্যবসার কাজে ব্যবহার না করে সব টাকাই বিভিন্ন জনের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে লুটপাট হয়। যে প্রতিষ্ঠানের এমডি অমিতাভ অধিকারী ও চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার স্ত্রী অনিতা কর। প্রকৃতপক্ষে সুবিধাভোগী হয়েছেন পি কে হালদার। অন্যদিকে ২০১৬ সালের জুনে ঋণের ৫ কোটি টাকার দুটি চেকের মাধ্যমে ওয়াকাহামা লিমিটেডের নামে আইএফআইসি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে ৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের হিসাবে স্থানান্তর করে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের ব্যক্তিগত হিসাবে সরিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
২০১৬ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর একটি চেক ব্যবহার করে ১১ কোটি ১৪ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে সরানো হয়। যা পরে কাগুজে প্রতিষ্ঠান দায়া শিপিং লিমিটেডের নাম ঋণ দেখানো হয়। এছাড়া রাজিব সোমের শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের হিসাবে ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া আনান কেমিক্যালের লেনদেন বিবরণী পর্যালোচনায় দুদক দেখতে পায়, ২০১৫ সালের নভেম্বরে ১৫ কোটি টাকা ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জমা হওয়ার পর মেসার্স বর্ণ, নিউট্রিক্যাল ও আরবি এন্টারপ্রাইজের নামে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই বছরে নভেম্বরেই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে আরও ৭ কোটি টাকা স্থানান্তরিত হয়, যা পরে ব্যাংকটির সুখাদা লিমিটেডের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, অমিতাভ অধিকারী হলেন পি কে হালদারের আপন খালাত ভাই এবং উজ্জ্বল কুমার নন্দী হলেন পি কে হালদারের পুরোনো অফিসের সহকর্মী। অপরদিকে উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। অর্থাৎ বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সে টাকা দিয়ে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন তারা। পরে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছে পি কে হালদার সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেটের আত্মসাতের বিষয়ে আরও জানা যায়, রেপটাইল ফার্ম-১ নামের কাগুজে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলে ৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিলেও ২০১৬ সালের বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক এশিয়ার কয়েকটি শাখার হিসাবের মাধ্যমে কৌশলে পি কে হালদারের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। যেখানে প্রতিষ্ঠানের এমডি রাজিব সোম, চেয়ারম্যান ও রাজিব সোমের স্ত্রী শিমু রয়, পরিচালক মোস্তাসিন বিল্লাহ ও উজ্জ্বল কুমার নন্দীকে দেখানো হলেও মূল সুবিধাভোগী ছিলেন পি কে হালদার। ওই একই বছর এঅ্যান্ডবি ট্রেডিং, ক্লিসটন ফুড অ্যান্ড একমোডেশন লিমিটেড, এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এবং পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ব্যবহার করে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে আরও ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে হাল ইন্টারন্যাশনালের নামে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হলেও পরে ব্যাংক এশিয়ায় আমরা হোল্ডিং লিমিটেড, মুন এন্টারপ্রাইজ, ওরাল লিমিটেড, সন্দীপ কর্পোরেশন, ফ্যাশন প্লাস ও মেলেডি হোমসের নামের পি কে হালদারের ব্যাংক হিসাবে অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৪ মে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোক নগরের একটি বাড়ি থেকে পি কে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রথম ইন্টারপোলে চিঠি পাঠিয়েছিল দুদক। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ জানুয়ারি ইন্টারপোল পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল। এরপর গত ১৪ মে পি কে হালদারকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর থেকে গ্রেপ্তারের পরদিন ১৫ মে ইন্টারপোলের ঢাকা ডেস্ক থেকে নয়াদিল্লি ডেস্কে আরও একটি চিঠি পাঠানো হয়।
আলোচিত পি কে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট ৪০টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতে ২২টি মামলা ও এফএএস লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতে ১৩ মামলা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার চার্জশিট ২০২১ সালের নভেম্বরে দাখিল করা হয়। যেখানে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে পি কে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। মামলার তদন্তকালে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শঙ্খ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৭৬ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করা হয়েছে।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews