বাজারের উত্তাপে দিশেহারা মানুষ : হুমকিতে খাদ্য নিরাপত্তা
প্রথম নিউজ, ঢাকা: নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে কোনো সুখবর নেই। প্রতিদিন কোনো না কোনো পণ্যের কৃত্রিম সংকট হচ্ছেই। যার কারণে সরকার প্রথমবারের মতো ৩টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, যাতে করে ঐ পণ্যের বাজার কিছুটা হলেও স্থিতিশীল রাখা যায়।
ভোক্তাদের জাতীয় সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)সহ অনেকে স্বাগত জানালেও কিছু কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আবার মতপ্রকাশ করেছেন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে দাম নির্ধারণ করে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যেহেতু এই কয়টি পণ্য নিয়ে কিছুদিন ধরেই কারসাজি চলমান ছিল। তাই সরকার বাধ্য হয়ে এই কাজটি করেছে, যাতে ঐ পণ্যের দামে কিছুটা হলেও রেশ ধরা যায়।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দাম নির্ধারণ করে দিলে হবে না। প্রয়োজন এই সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং কৃষি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে নিয়ে সমন্বিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মতে, ব্যবসায়ীরা বাজার তদারকিকে হাস্যকর করার জন্য নানা ফন্দিফিকির করতে চায়। এজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
একই সাথে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে স্থায়ী প্রথা অনুসরণ বাদ দিয়ে যেসব পণ্য নিয়ে কারসাজি হবে সেইগুলো দ্রুত আমদানি করে বাজার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সংকট কেটে গেলে আবার পুনরায় আগের স্থানে ফিরতে হবে, এই নীতি অনুসরণ করতে হবে। তাহলেই এই সংকটের আশু সমাধান হবে।
অনেকের মতে, অতি মুনাফা এখন সামাজিক সংক্রমণে পরিণত হয়েছে। আর এজন্য আইনের প্রয়োগ না হওয়াই দায়ী। এক সময় কিছু পণ্য নিয়ে কারসাজি হতো, আর এখন কারসাজি হয় না এমন পণ্য পাওয়া ভার। ব্যবসায়ীরা নীতি নৈতিকতা ভুলে শুধু লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। যা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশনি সংকেত। ব্যবসায় সুস্থ ধারা ফেরাতে ব্যবসায়ী সংগঠন ও নেতৃবৃন্দদের এই সংকটে সরকারের পাশে থাকতে হবে।
ব্যবসায়ীরা একবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে বিশ্বে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা সমস্যার কথা বলে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির করেছিল। আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট, এলসি খোলা যাচ্ছে না, আবার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এভাবে নানা অজুহাত সামনে এনে অস্থিরতা তৈরি করে। এর ফলে বাড়ে আমদানি করা পণ্যের মূল্য।
যার ফলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে খাবারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২.৫৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে খাদ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের অক্টোবরে ১২.৮২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায়। সেইখানে এর পরিমাণ ১২.৭১ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুলাইতে তা ছিল ৯.৮২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪০ শতাংশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএও এর তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসে সারা বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে সর্বনিম্ন হয়েছে। এমন এক সময়ে দেশে এই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে যখন আশেপাশের দেশসহ সারা বিশ্বে এটি কমে আসছে।
খাবারের দাম কমেছে সারা বিশ্বে, দেশে উল্টো রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি। এই সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারের প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। তবে উল্টোচিত্র দেখা গেছে বাংলাদেশে। অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়াটা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশ সুদহার বাড়িয়ে যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছে সেইখানে বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টো পথে। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে এখনো কৌশলে সুদহার কমিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া বাজার অব্যবস্থাপনার কারণেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের লক্ষণীয় কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি এক বছরের বেশি সময় ধরে।
যার কারণে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব ধরনের জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মাছ-মাংসসহ সব ধরনের খাবারই নয়; দাম বাড়ছে তেল, সাবান, প্রসাধন সামগ্রী, পোশাক-আশাক, শিক্ষাসামগ্রী, গণপরিবহনসহ সবকিছুর।
নিত্যপণ্যের দাম কতটা বেড়েছে, তার চিত্র উপস্থাপন করার প্রয়োজন না হলেও সবাই বাজারের উত্তাপ সম্পর্কে অবহিত আছেন। সবজি, মাছ অথবা নিত্যপণ্যের বাজারে দামের উত্তাপ। সাধারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ক্রেতারা বেশি সংকটে আছেন। বাজারে গেলেই সাধারণ মানুষের ‘বুকে ব্যথা বেড়ে যায়’। বাজারে গেলেই পণ্যমূল্যের সবকিছুর দাম শুনলে বুক ধড়ফড় করে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন বাজারে খবর নিলেই ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললে মোটামুটি একই চিত্র পাওয়া যাবে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের বেশিরভাগ মানুষকে সংসার চালাতে এখন প্রতিটি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে।
বর্তমানে প্রচলিত বাজার তদারকির মডেল একটি সফল মডেল হলেও কিছু ব্যবসায়ী বাজার তদারকির এই কার্যক্রমকে ব্যর্থতায় রূপান্তরিত করতে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। বাজার তদারকিতে এখন ভোক্তা অধিকার ছাড়া সরকারের অন্য কোনো দপ্তর দেখা যায় না। এক সময় জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, ডিএমপি, বিএসটিআই বাজার তদারকি করলেও এখন তাদের আর এই কাজে দেখা যায় না। আর ভোক্তা অধিকারের লোকবল একেবারেই সীমিত। জেলা পর্যায়ে মাত্র ১ জন কর্মকর্তা দিয়ে এই কার্যক্রম সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
ক্যাব থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছে, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত অফিস স্থাপন ও লোকবল পদায়ন করার পাশাপাশি জেলা ও কেন্দ্রীয়ভাবে আরও লোকবল বাড়াতে হবে। বর্তমানে ১৬টি জেলায় ভোক্তার কর্মকর্তা নেই। তাহলে তারা কীভাবে এই তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করবে?
ঢাকা শহরে সিটি কর্পোরেশনের ১০০টি বাজার আছে আর এর বাইরে হাজার খানেক বাজার থাকলেও ভোক্তার টিম মাত্র ২টি। তা দিয়ে এই বিশাল কার্যক্রম তদারকি সম্ভব নয়। তাই সরকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভোক্তার কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করার দিকে মনযোগী হতে হবে। একই সাথে বিদ্যমান আইনের সংস্কার করতে হবে। অনেকগুলো অত্যাবশ্যকীয় সেবায় আইনের আওতায় প্রতিকার দেওয়া যায় না।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)