প্রেম ও বিপ্লবে কাশ্মীর নিয়ে আলোড়ন তুলেছিল যে সিনেমা

প্রেম ও বিপ্লবে কাশ্মীর নিয়ে আলোড়ন তুলেছিল যে সিনেমা

প্রথম নিউজ, বিনোদন ডেস্ক: সিনেমা যখন শুধু বিনোদন নয়, হয়ে ওঠে আবেগ, দায়িত্ব আর দেশপ্রেমের এক অসাধারণ মিশেল- তখনই জন্ম নেয় ‘রোজা’র মতো চলচ্চিত্র। ১৯৯২ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিপ্রাপ্ত এই দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাটি ছিল এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। সময়ের পরিক্রমায় আজও সিনেমাটি নব্বই দশকের দর্শকের কাছে এক নস্টালজিয়া, বিপ্লবী অনুভব। নতুন প্রজন্মের দর্শকের কাছেও ‘রোজা’ মুগ্ধতার এক নাম। এটি শুধু ভারতীয় চলচ্চিত্রেই নয়, যুদ্ধের জন্য আলোচিত বিশ্ব চলচ্চিত্রের তালিকাকেও সমৃদ্ধ করেছে।

প্রখ্যাত নির্মাতা মণি রত্নম ছবিটি বানিয়েছেন রোজা নামের এক সাধারণ মেয়েকে কেন্দ্র করে। যার স্বামী রিষি কুমারকে নিয়ে এগিয়ে চলে গল্পটি। রিষি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’তে কাজ করা একজন ক্রিপ্টো এনালিস্ট। তাকে সরকারি কাজে কাশ্মীরে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে জঙ্গিদের হাতে অপহৃত হন তিনি। স্বামীকে ফিরে পেতে শুরু হয় এক নারীর এক দীর্ঘ লড়াই। সরকারি দফতর, সন্ত্রাস, দুর্বোধ্য ভাষা, নিঃসঙ্গতার বিপরীতে ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার আকুলতায় রোজা হয়ে ওঠে করুণ পরীক্ষায় অবিচল থাকা সাহসী নারীর প্রতিনিধি। দর্শক এই রোজার প্রেমে পড়ে যান, এই রোজার দেশপ্রেমে আপ্লুত হন এবং একজন যোগ্য স্ত্রী বা জীবনসঙ্গী হিসেবে রোজাকে শ্রদ্ধা করে ফেলেন। অবচেতন মনে দর্শকই হয়ে যান একেকজন রোজা। অন্যদিকে ঋষিকে দেখা যায় দেশপ্রেমে বলীয়ান এক যুবক হিসেবে। যিনি দেশের জন্য নিজের মুক্তি তথা জীবনকেও বাজি ধরতে পারেন।

রোজার চরিত্রে অভিনয় করেছেন দক্ষিণ ভারতের অভিনেত্রী মাধু। তার স্বামী রিষি কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তামিলের অরবিন্দ স্বামী। দুজনেই এমন সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের চরিত্র দুটি যা বাস্তবকে ছুঁয়ে যায়। আরও দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন পঙ্কজ কাপুর, বৈষ্ণবী, নাসার প্রমুখেরা।

সাধারণত ব্যতিক্রমী ছবির মতো কেবল আলোচনা বা প্রশংসাতেই নয়, ‘রোজা’ ছিল ব্যবসায়িকভাবেও সফল একটি সিনেমা।১৯৯০ সাল থেকে শুরু হয়েছিল সিনেমাটির নির্মাণ কাজ। মণি রত্নমের ছবিটি নির্মিত হয়েছিল মাত্র ১ কোটি রুপি খরচ করে। আর এটি আয় করেছিল প্রায় ১৮ কোটি রুপি। যা সেই সময়ের বিচারে ব্লকবাস্টার হিট। ছবিটি তামিল ভাষায় নির্মিত হলেও হিন্দি, তেলেগু, মালায়লাম ও কন্নড় ভাষাতেও ডাবিং করা হয়েছিল।

‘রোজা’ সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি তার প্রেক্ষাপট- কাশ্মীর। ছবিটির শুরুতেই দেখা যায় স্বর্গসদৃশ প্রকৃতি, ঝরনা, বরফে ঢাকা পাহাড়। আর শেষদিকে সেই একই স্থান হয়ে ওঠে যুদ্ধের, হিংসার, আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। ছবিতে কাশ্মীর একইসঙ্গে শান্তি ও সন্ত্রাসের প্রতীক হয়ে ফুটে ওঠেছে। দুই সত্তার সেই দ্বন্দ্বময় পরিচয় নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে কাশ্মীর। যেখানে স্বর্গের হাওয়া বয়। আবার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ফাঁদে মৃত্যুও ওত পেতে থাকে।

‘রোজা’ ছবির নির্মাণশৈলী, গল্প, শক্তিশালী অভিনয় সর্বত্র প্রশংসিত। তবে এর দারুণ সব গানগুলোও ছবিটিকে সাফল্যের পথে এগিয়ে দিয়েছিল। ছবির গানগুলো তৈরি করেছিলেন এ আর রহমান। এটাই ছিল সিনেমায় তার প্রথম কাজ। সিনেমায় নাম লিখিয়েই তিনি জানান দিয়েছিলেন, কেন তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তার তৈরি গানগুলো ছিলো প্রেম আর বিপ্লবের আবেগী বিস্ফোরণ।

‘রোজা’ এক নারীর চোখ দিয়ে দেখা কাশ্মীরের সৌন্দর্য ও সমস্যার কথা বলেছে, ধুলো জমে থাকা সরকারি ব্যবস্থার দুর্বলতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, সন্ত্রাসবাদে বিপক্ষে ভালোবাসার জন্য যুদ্ধের অদম্য শক্তির এক অনবদ্য কাহিনী হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ ও প্রেমের এতো সুন্দর মেলবন্ধন খুব কম সিনেমাতেই দেখা গেছে। যারা ‘রোজা’ দেখেছেন তারা স্বীকার করবেন এটি কেবল উপভোগের একটি চলচ্চিত্রই নয়, চিরকালীন একটি অনুভব। যে অনুভব দেশ ও প্রিয়জনকে সবকিছুর উর্দ্ধে গিয়ে ভালোবাসতে শেখায়।