নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবছে ইসরাইল

নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবছে ইসরাইল

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্ব আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াল ইসরাইল। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ইসরাইলের বিরুদ্ধে ৮৪ পৃষ্ঠার নথিতে ‘গণহত্যা’র অভিযোগ তোলে দক্ষিণ আফ্রিকা। বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টায় সেই মামলার শুনানি শুরু হয়। দুদিনের শুনানির প্রথম দিনই ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আদালতের নিয়ম অনুসারে, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরাইলের অতিরিক্ত দুই বিচারকের উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে বিচারপর্ব শুরু করা হয়। 

এরপর একের পর এক চলে যুক্তি স্থাপন বক্তৃতা। শুনানির একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ম্যাক্স ডু প্লেসিস তার বক্তৃতায় বলেছেন, ‘ইসরাইল বছরের পর বছর ধরে আইন লঙ্ঘন করে গাজায় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবছে ইসরাইল।’ আলজাজিরা, গার্ডিয়ান, এপি, আনাদোলু এজেন্সি। আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) ১৫ জন বিচারক নিয়ে গঠিত। কিন্তু নিয়মানুসারে প্রতি মামলায় বাদী-বিবাদীর থেকে একজন করে অতিরিক্ত ২ সদস্যসহ মোট ১৭ জন বিচারকের আসনে বসেন। এ মামলায়ও একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

ইসরাইলের পক্ষ থেকে বিচারকের আসনে বসেছেন, গাজা হামলার সবচেয়ে বড় সমর্থক ও কট্টর ফিলিস্তিন বিরোধী বিচারক আহারন বারাক (৮৭)। তিনি ইসরাইল সুপ্রিমকোর্টের সাবেক প্রেসিডেন্ট (সাবেক প্রধান বিচারপতি)। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে বিচারপতি হিসাবে দেশটিকে প্রতিনিধিত্ব করছেন সাবেক উপ-প্রধান বিচারপতি ডিকগাং মোসেনেকে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক জন ডুগার্ড। দলের অন্য  সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবী আদিলা হাসাম, দক্ষিণ আফ্রিকার বিচারমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা, জোহানেসবার্গ বারের অ্যাডভোকেট টেম্বেকা এনগকুকাইতোবি এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবী ম্যাক্স ডু প্লেসিস। দলে আইনজীবী শিদিসো রামোগালে, সারাহ পুডিফিন-জোনস এবং লেরাটো জিকালালাও রয়েছেন। পরামর্শদাতা হিসাবে রয়েছেন, আইরিশ আইনজীবী ব্লিন নি ঘ্রালাই এবং ব্রিটিশ ব্যারিস্টার ভন লো। দুই বিচারকের বক্তব্যের পর নেদারল্যান্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত ভুসিমুজি মাদনসেলা বক্তৃতার কার্যপ্রণালি শুরু করেন। বলেন, গাজায় ইসরাইল যা করছে তা গণহত্যা। এটি ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত অবৈধ কাজের ধারাবাহিকতার অংশ। এর পরপরই দক্ষিণ আফ্রিকার বিচারমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা বলেছেন, ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলে সহিংসতা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়নি। ফিলিস্তিনিরা গত ৭৬ বছর ধরে নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়ন ও সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে। শুনানিতে আইনজীবীদের পক্ষে প্রথম বক্তা ছিলেন আদিলা হাসিম। 

ইসরাইলকে তুলোধনা করে বলেন, ইসরাইল প্রতি সপ্তাহে গাজায় ৬ হাজার বোমা ফেলেছে। কমপক্ষে ২০০ বার ২ হাজার পাউন্ড (৯০৭ কেজি) বোমা দক্ষিণ গাজায় ফেলা হয়েছে। কেউই রেহাই পায়নি। এমনকি সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুও নয়। জাতিসংঘ গাজাকে শিশুদের কবরস্থান হিসাবে অভিহিত করার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি। 

বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী তুলে ধরে বলেন, পরিস্থিতি এমন যে, গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান সেখানকার মানুষকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। গাজায় আরও বেশি মানুষ অনাহারে এবং রোগে মারা যেতে পারে। আরও বলেন, গাজায় জেনেভা কনভেনশনকেও পাত্তা দেয়নি ইসরাইল। কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২ লঙ্ঘন করেছে। ইসরাইলের এ কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন তিনি।

অধ্যাপক  জন ডুগার্ড বলেছেন, ৭ অক্টোবর ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইল নির্বিচারে নিরীহ ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের হত্যা করেছে। যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আইনজীবী ব্লিন নি ঘ্রালাই বলেছেন, ইসরাইলের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য জরুরি অস্থায়ী ব্যবস্থার প্রয়োজন। ব্যারিস্টার ভন লোও বলেছেন, ইসরাইল গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে তার বাধ্যবাধকতার বিপরীতে কাজ করেছে কিনা, তা নির্ধারণ করবে আন্তর্জাতিক আদালত।

গাজায় ইসরাইলের ভয়াবহ আক্রমণ নিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী টেম্বেকা এনগকুকাইতোবি। তার মতে, নকশা করেই গাজায় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ইসরাইল। বলেন, ‘গাজায় ধ্বংসের মাত্রা- বাড়িঘর এবং বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা, শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সবই স্পষ্ট করে যে গণহত্যার পরিকল্পনাই বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়েছে। ইসরাইলের স্পষ্ট উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনিদের জীবন ধ্বংস করা।’ এরপর তিনি প্রমাণ হিসাবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কিছু বিদ্বেষাত্মক বক্তব্য তুলে ধরেন। বলেন, ‘ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উসকানিতেই গাজায় গণহত্যা হয়েছে।’ প্রমাণ উপস্থাপনে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নেতানিয়াহুর  এক বক্তব্যের বাইবেলের কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। সেখানে ইসরাইলি বাহিনীর মনে প্রতিশোধমূলক মনোভাব জাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন আমালেক আপনার সাথে কি করেছে।’  উল্লেখ্য, হিব্রু বাইবেলে আমালেক একটি জাতি যারা ইসরাইল গোত্রের ওপর আক্রমণ করেছিল। তখন সৃষ্টিকর্তা আমালেক জাতিকে কঠিন শাস্তি ও অভিশাপ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এনগকুকাইতোবি বলেন, ‘একটি সম্পূর্ণ গোষ্ঠীর প্রতিশোধমূলক ধ্বংসের জন্য ঈশ্বরের বাইবেলের আদেশকে তুলে ধরেছিলেন তিনি।’ এমনকি  ৩ নভেম্বর, ২০২৩ সালে ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনীকে একটি চিঠিতে জনাব নেতানিয়াহু একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। 

বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিরা তাদের যুক্তি শেষ করেন। আইসিজে প্রেসিডেন্ট জোয়ান দোনোগু ঘোষণা করেন, ‘আজকের শুনানি স্থগিত করা হয়েছে এবং আদালত আগামীকাল ইসরাইলের মৌখিক যুক্তি শোনার জন্য মিলিত হবে। আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমরা আজকের শুনানিতে হেগ ও অন্যান্য শহর থেকে আপনাদের প্রতিক্রিয়া এবং বিশ্লেষণ নিয়ে আসছি।’