দাম নিয়ে বিপর্যস্ত জামদানি শিল্পীরা
ভালো নেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকার জামদানি শিল্পীরাও। সব কিছুর দাম বৃদ্ধি হলেও তাদের শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি।
প্রথম নিউজ, নারায়ণগঞ্জ: প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। আর এই দাম বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠেছে সীমিত আয়ের মানুষের। এতে ভালো নেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকার জামদানি শিল্পীরাও। সব কিছুর দাম বৃদ্ধি হলেও তাদের শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সুতার মূল্য বৃদ্ধিতে তারা আরও বেশি বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়ার চিন্তা করছেন।
জামদানি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকায় তৈরি জামদানি শাড়ি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেও এখান থেকে তৈরি করা শাড়ি পরিধান করে থাকেন। এখানকার তাঁত শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে ক্রমাগত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের এই পেশা ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন আর আগের মতো লাভবান হতে পারছে না। এতদিন সীমিত আয়ে ব্যবসা পরিচালনা করলেও সেই সীমিত আয় করাও তাদের জন্য দূরহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জামদানি শিল্পী মো. ইয়াসিন বলেন, সবকিছুরই দাম বাড়ছে, শুধু আমাদের দামই বাড়ে নাই। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কথা কে শুনে? আমাদের দিকে নজর দেওয়ার কারো সময় নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে কত কষ্টে আমাদের জীবন কাটে সেটা কেউ দেখে না। ছোটবেলা থেকেই এই পেশায় জড়িত, ফলে অন্য কোথাও যেতেও পারি না।
কামাল হোসেন নামে আরেক জামদানি শিল্পী বলেন, সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের লাভ করাটা খুবই কষ্টকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে সিল্কের সুতা কেনা হতো ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। কিন্তু এই কয়েকদিনের ব্যবধানে সেটা বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে। কটন সুতা ১৬০ টাকা মুড়া পাওয়া যেত। এখন সেটা ২৫০ টাকা মুড়া হয়েছে। আগে জরি পাওয়া যেত ৮ টাকা তোলা। এখন সেটা ১২ টাকা তোলা। আর এগুলোই মূলত জামদানি শিল্পের মূল উপাদান। তিনি আরও বলেন, এভাবে সবকিছুরই দাম বাড়ছে। আমি ৪০ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত। কিন্তু এখন নতুন করে এই পেশায় কেউ আসতে চায় না। কারণ এখন এই পেশার মূল্যায়ন নেই। ফলে মানুষ এখন পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
জামদানি সুতার দোকানদার ফয়সাল বলেন, কটন সুতা বস্তাপ্রতি ১২ হাজার টাকায় পাওয়া যেত। এখন সেটা বেড়ে ২৮ হাজার টাকা বস্তা হয়েছে। এক বস্তায় ১০০ পাউন্ড সুতা থাকে। সেইসঙ্গে সিল্ক সুতা ৫ হাজার টাকা কেজি পাওয়া যেত। এখন সেটা ৮ হাজার টাকা কেজি করে কিনতে হয়। রাজন জামদানি হাউসের মালিক মো. নূরে আলম খাঁন বলেন, এই ব্যবসাটা ধরে রাখাটা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে জানি না এর ভবিষ্যত কী হবে? কোনো ক্রেতা পাওয়া যায় না। এখন মেশিনের মাধ্যমে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। সেই জামিদানি হাতে তৈরি করা বলে চালিয়ে দেয়। মানুষ তো আর চিনে না। তারা কম দামে কিনতে পেরে খুশি।
আলিফ জামদানি হাউসের মালিক মো. নবী হোসেন বলেন, সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে। এখন একটা জিনিস বিক্রি করতে গেলে আগের মতো আয় করা যায় না। আগে এক পিস সুতার লাচ্চি ৬ টাকায় কিনতে পারতাম। এখন সেটা ১৫ টাকায় কিনতে হয়। কিন্তু আমাদের তৈরিকৃত পণ্যের দাম তো আর বাড়ে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, আসলে বিসিক সরাসরি ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত না। বিসিক শুধু সার্ভিসের সঙ্গে সম্পর্কিত। যার কারণে আমাদের এখানে কাজগুলো শিল্প নগরীতে উন্নীত করার জন্য বেসরকারি উদ্যাক্তাদের মাঝে দিয়ে থাকি। তারা এখানে এসে সেটআপ করে। সেটআপের সুযোগ সুবিধা আমাদের এখতিয়ারে। এর বাইরে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে কোনো জিনিসের আপডাউন করলে এখানে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তিনি আরও বলেন, তাদের মূল্যায়ন না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত এখানে যারা শ্রম দেয় সেসকল কারিগররা মালিকদের কাছ থেকে সেভাবে মজুরি পায় না। দ্বিতীয়ত টেক্সটাইল হয়ে যাওয়ায় তাদের কাজ দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। সেইসঙ্গে এই কাজটা শিশু অবস্থা থেকে শিখতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করলে হাতে চোখে সমস্যা হয়ে যায়। যার কারণে অনেকেই এই কাজ করতে চায় না। টেক্সটাইলে কাজ করলে ভালো বেতন পাওয়া যায়। ফলে রুট লেভেল থেকে উঠে আসা কারিগর কমে যাচ্ছে।
এছাড়া শ্রমের মূল্য আসলেই কম। তারা যে পরিমাণ শ্রম দেয় এবং একটি শাড়ি যে দামে বিক্রি হয় সে তুলনায় আসলেই শ্রমিকদের মূল্য কম। এই বিষয়টা মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকপক্ষের ওপর নির্ভর করে। সুতার দাম বৃদ্ধিতে সার্বিকভাবে মালিকপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। আশিকুর রহমান বলেন, আরেকটা বিষয় হচ্ছে মেশিনে জামদানি তৈরি করা হয়। দুই ঘণ্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে যায়। যদিও মান খারাপ থাকে। যার কারণে মূল উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে যদি সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে ট্রেনিং সেন্টার করা না হয় কিংবা কোনো ভর্তুকি দেওয়া না হয় তাহলে সেটা টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews