“দুই মাসে ৭০৮টি সড়ক দুর্ঘটনার গেল ৮৪৬ প্রাণ, আহত ১০৫৭ জন”
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে
প্রথম নিউজ, ঢাকা: সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এই দুই মাসে সারাদেশে ৭০৮টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৮৪৬ জন ও আহত হয়েছেন এক হাজার ৫৭ জন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আজ বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনের তথ্য জানায় সংগঠনটি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩০৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৪৮ জন। যা মোট নিহতের ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৯৪ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৯১ জন।
সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়াও এ সময়ে ১৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত, ৯ জন আহত ও ১৫ জন নিখোঁজ হন। আর ৩২টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত ও ছয়জন আহত হন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩০১টি জাতীয় মহাসড়কে, ২৩১টি আঞ্চলিক সড়কে, ১০৫টি গ্রামীণ সড়কে, ৬১টি শহরের সড়কে ও অন্যান্য স্থানে ১০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনাগুলোর ১৬২টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৬৫টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৯৬টি পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৭২টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা ও ১৩টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। পথচারী নিহতের মাত্রাও চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলেন না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলাচল বরে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র: দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ৩৪৮ জন (৪১.১৩%), বাস যাত্রী ৫৪ জন (৬.৩৮%), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি যাত্রী ৪৯ জন (৫.৭৯%), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স যাত্রী ১৬ জন (১.৮৯%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা) ১৪৩ জন (১৬.৯০%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম)৩৩ জন (৩.৯০%) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ৯জন (১.০৬%) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন: রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩০১টি (৪২.৫১%) জাতীয় মহাসড়কে, ২৩১টি (৩২.৬২%) আঞ্চলিক সড়কে, ১০৫টি (১৪.৮৩%) গ্রামীণ সড়কে, ৬১টি (৮.৬১%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ১০টি (১.৪১%) সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন: দুর্ঘটনাসমূহের ১৬২টি (২২.৮৮%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৬৫টি (৩৭.৪২%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৯৬টি (২৭.৬৮%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৭২টি (১০.১৬%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৩টি (১.৮৩%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন: দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৫.১১ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ৩.৮০ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স ৪.৫৯ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১৩.৩৫ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৯.১৭ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু) ১৭.৩২ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-টমটম-মেসিগাড়ি-আলগানন) ৪.৮৬ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১.৭৬ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা: দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১,১৩১টি। (ট্রাক ২১৫, বাস ১৫১, কাভার্ডভ্যান ২৬, পিকআপ ৪২, ট্রলি ১৮, লরি ১০, ট্রাক্টর ১২, মাইক্রোবাস ১৬, প্রাইভেটকার ২৭, অ্যাম্বুলেন্স ৭, পুলিশ পিকআপ ২, ড্রাম ট্রাক ২, কার্গো ট্রাক ১, লং ভেহিকেল ১, মোটরসাইকেল ৩৩০, থ্রি-হুইলার ১৯৬ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৫৫ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-বোরাক-মেসিগাড়ি-মাহিন্দ্র-টমটম-আলগানন) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ২০টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ: সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৪.৫১%, সকালে ৩১.৩৫%, দুপুরে ১৮.৭৮%, বিকালে ২০.৩৩%, সন্ধ্যায় ৬.০৭% এবং রাতে ১৮.৯২%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান: দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৫.১৪%, প্রাণহানি ২৩.৭৫%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.১২%, প্রাণহানি ১২.৪১%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৬.২৪%, প্রাণহানি ১৭.৭৩%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১২%, প্রাণহানি ১৩%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৩২%, প্রাণহানি ৯.৬৯%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.০৬%, প্রাণহানি ৭.০৯%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৪৯%, প্রাণহানি ৬.৫০% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৬০%, প্রাণহানি ৯.৮১% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৭৮টি দুর্ঘটনায় নিহত ২০১ জন। সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে। ৪৬টি দুর্ঘটনায় নিহত ৫৫ জন। একক জেলা হিসেবে ময়মনসিংহ জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৩৪টি দুর্ঘটনায় ৪৯ জন নিহত। সবচেয়ে কম রাঙ্গামাটি জেলায়। ৩টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কেউ হতাহত হয়নি।
আহত ও নিহতদের পেশাগত পরিচয়: গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৭ জন, সেনা সদস্য ২ জন, বিমান-বাহিনী সদস্য ১ জন, এপিবিএন সদস্য ১ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ২ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ২৩ জন, নাটোর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ১ জন, পল্লী-চিকিৎসক ২ জন, নার্স ১ জন, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ১ জন, এলজিইডি’র ইঞ্জিনিয়ার ১ জন, পশুসম্পদ কর্মকর্তা ১ জন, ভূমি কর্মকর্তা ১ জন, নির্বাচন অফিসের কর্মচারী ১ জন, সাংবাদিক ৬ জন, জেলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ১ জন, ইমাম ২ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৪ জন, ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৯, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৩৮ জন, প্রবাসী ১ জন, পোশাক শ্রমিক ১৮ জন, রেল শ্রমিক ২ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৬ জন, ইটভাটা শ্রমিক ২ জন, চাতাল শ্রমিক ৩ জন, কাঠমিস্ত্রি ২ জন, লেদমিস্ত্রি ১ জন, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ১ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ৪ জন, ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৭ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১১৮ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন;
২. বেপরোয়া গতি;
৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা;
৪. বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা;
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল;
৬. তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো;
৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;
৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা;
৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি;
১০ গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ:
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে;
২. চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;
৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে;
৪. পরিবহণের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে;
৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;
৭. গণপরিবহণে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে;
৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে;
৯. টেকসই পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে;
১০. ‘সড়ক পরিবহণ আইন- ২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।