‘জীবন ফুরিয়ে’ যাচ্ছে ফারইস্ট লাইফের
২০২০ সালের শুরুর দিকে লাইফ ফান্ড ছিল ৩৩৭২ কোটি ৬০ লাখ টাকা, তিন বছরে লাইফ ফান্ড থেকে ২৯০৪ কোটি ৮ লাখ টাকা উধাও, জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধের উদ্যোগ
প্রথম নিউজ, ঢাকা: একসময় দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জীবন বিমা কোম্পানি ছিল ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। মালিকপক্ষের ব্যাপক লুটপাট ও অনিয়মের কারণে কোম্পানিটির এখন হায় হায় অবস্থা। দিন যত যাচ্ছে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ততই নাই হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন ধীরে ধীরে কোম্পানিটির জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে যারা কোম্পানিটির দায়িত্বে রয়েছেন তারও উদ্ধারের সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের শুরুর দিকে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ৩ হাজার ৩৭২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সেই লাইফ ফান্ড ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০২২ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকায়। অর্থাৎ তিন বছরে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড নতুন কোনো অর্থ যোগ হয়নি, উল্টো ২ হাজার ৯০৪ কোটি ৮ লাখ টাকা নাই হয়ে গেছে।
জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ডকে রক্তের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মানুষ রক্তশূন্য হয়ে পড়লে যেমন বাঁচে না, তেমনি একটি জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়লে ওই কোম্পানির পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে বিমা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়া মারাক্তক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।
বর্তমানে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কয়েক হাজার গ্রাহকের বিমা দাবি বকেয়া পড়েছে। এসব গ্রাহক দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তাদের দাবির টাকা আদায় করতে পারছেন না। অপরদিকে কোম্পানির দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, কোম্পানিটিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রেও বিপত্তি দেখা দিয়েছে। কোম্পানির আগের পরিচালকরা যে দামে জমি কিনেছেন, এখন বিক্রি করতে গিয়ে সে দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফে ব্যাপক লুটপাট চালানোর অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম এবং সাবেক পরিচালক এম এ খালেক জেলহাজতে। এই দুই ব্যক্তি বিভিন্ন উপায়ে কোম্পানিটি থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন।
ফারইস্ট লাইফের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা আলোচ্যসূচি ও সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক্সট্রাক্ট বা প্রতিলিপি তৈরি ও ইস্যু করে কোম্পানির বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা এমটিডিআর/আমানত সাবেক পরিচালক এম এ খালেক এবং সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লোনের বিপরীতে জামানত দিয়ে এবং ওই জামানত বাবদ কোম্পানির মোট এমটিডিআর ৮১৬ কোটি টাকা ব্যাংকের সমন্বয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। এই এমটিডিআর হালনাগাদ মুনাফাসহ ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে।
এই দুই সাবেক পরিচালক ও চেয়ারম্যান তাদের নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে কম মূল্যে জমি ক্রয় করে সেই জমি কোম্পানি বরাবর বেশি দামে বিক্রি করে প্রায় ৬৬৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ২৮৭ কোটি টাকা এই পরিচালকরা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া কোম্পানির বিভিন্ন ক্রয় লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
নজরুল ইসলাম এবং এম এ খালেকের এসব অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর নজরুল ইসলাম এবং এম এ খালেকের নিয়ন্ত্রণাধীন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে স্বাধীন পরিচালকের সমন্বয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে। এসব অনিয়ম উদঘাটনের জন্য বিএসইসি এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) একাধিক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব নিরীক্ষার মাধ্যমে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়ম উদঘাটিত হয়েছে, যার সঙ্গে সরাসরি এই পরিচালকরা জড়িত ছিলেন।
পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হলেও বিপদ থেকে বের হতে পারেনি ফারইস্ট লাইফ। সর্বশেষ ২০২২ সালে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ১ হাজার ২৫৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা কমে গেছে। বছরটির শুরুতে লাইফ ফান্ড ছিল ১ হাজার ৭২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকায়।
এর আগে ২০২১ সালের শুরুতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ২ হাজার ৪৭৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বছর শেষে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ লাইফ ফান্ড কমে ৭৪৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০২০ সালে লাইফ ফান্ড কমে ৮৯৮ কোটি ৩ লাখ টাকা। ওই বছরের শুরুতে লাইফ ফান্ড ছিল ৩ হাজার ৩৭২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
ফারইস্ট লাইফের এই করুণ পরিণতির বিষয়ে একটি জীবন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, ‘লাইফ ফান্ডকে জীবন বিমা কোম্পানির প্রাণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ফারইস্ট লাইফের লাইফ ফান্ড যেভাবে কমছে, তাতে মনে হচ্ছে ধীরে ধীর কোম্পানিটির জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোম্পানিটি বড় ধরনের সংকটের মধ্যে রয়েছে। কোম্পানিটিকে বাঁচিয়ে রাখা বড় কঠিন কাজ হবে।’
ধারাবাহিকভাবে লাইফ ফান্ড কমার পাশাপাশি কোম্পানিটির আয়-ব্যয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একদিকে আয় কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে ব্যয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না। ফলে আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধভাবে অর্থ ব্যয় করছে কোম্পানিটি। এতে গ্রাহকদের পাওনা টাকা আদায় আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করেছে ১০৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০২১ সালে এই আয় ছিল ১১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অপরদিকে ২০২২ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ৫৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০২১ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় ছিল ৫৭৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির উভয় প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে।
ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালে কোম্পানিটি মোট ব্যয় করেছে ১৫২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী বছরটিতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১৩৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ১৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ২০২১ সালে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয় ১৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত দুই বছরেই কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে প্রায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কোম্পানিটির বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিন বছরে কোম্পানিটি প্রায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে ভেঙে ফেলেছে। ২০২০ সাল শেষে কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২ হাজার ৬৩৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০২২ সাল শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
একদিকে প্রতি বছর আইন লঙ্ঘন করে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা এবং বিনিয়োগ ভাঙা হলেও গ্রাহকরা কোম্পানিটি থেকে বিমা দাবির টাকা পাচ্ছেন না। মাসের পর মাস গ্রাহকরা দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও দাবির টাকা আদায় করতে পারছেন না। ফারইস্ট লাইফের গ্রাহক হাওয়ানুর বলেন, ‘অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে ফারইস্ট লাইফে বিমা করেছিলাম। বিমা পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানিতে ধরনা দিচ্ছি। অনেকের কাছে গিয়েছি। কিন্তু দাবির টাকা পাচ্ছি না। কোম্পানি দাবির টাকা পরিশোধে নতুন নতুন তারিখ দেয়, কিন্তু টাকা দেয় না।’
ফারইস্ট লাইফের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘ফারইস্ট লাইফের চরম বিপদের সময় আমরা দায়িত্ব পেয়েছি। কোম্পানিটিতে হাজার হাজার গ্রাহক পাওনাদার। সুতরাং এই কোম্পানির ওপর থেকে গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এখন যদি গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করা হয়, তাহলে আস্থা ফিরে আসবে। তিনি বলেন, ‘আইডিআরএ বলছে যে জায়গা আছে, তা বিক্রি করতে। তবে সমস্যা হচ্ছে জায়গা কিনেছে বেশি টাকা দিয়ে। টাকা আত্মসাৎ বা যাই হোক কিছু করেছে, এখন আমরা জায়গা বিক্রি করতে গেলে কেনা দাম পাই না। কেনা দামের থেকে বেশিতে আমরা একটি জমি বিক্রি করেছি। অন্য জমিগুলোও বিক্রির চেষ্টা চলছে। জমি বিক্রির টাকা দিয়ে গ্রাহকের কিছু দাবি পরিশোধ করা হচ্ছে।’
কোম্পানিটিকে বাঁচানো সম্ভব হবে কি না- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় টাকা পেলে কোম্পানিটিকে আবারও ওঠানো সম্ভব। আমরা লোনের কথা বলেছি, যদি লোন পায় এবং কোম্পানির অনেক জায়গা আছে, সেই জায়গা যদি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা যায়, তাহলে দাঁড়ানো যায়। তবে খুব মুশকিল। এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় লোকজন ভাঙচুর করছেন, এটা স্বাভাবিক।’