কর ও ভ্যাটে বাড়বে চাপ

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সর্বোচ্চ ঋণের লক্ষ্য। বাড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর কর আর ভ্যাটের বোঝা।

কর ও ভ্যাটে বাড়বে চাপ

প্রথম নিউজ, অনলােইন : অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী চাপ। ডলার সংকটে রিজার্ভের পতন অব্যাহত। রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সর্বোচ্চ ঋণের লক্ষ্য। বাড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর কর আর ভ্যাটের বোঝা। আছে আইএমএফ’র ঋণের শর্ত পূরণ। অর্থনীতির সংকট সামলাতে এসব বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে সরকার। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করেছে সরকার। এটি চলতি (২০২৩-২৪) সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১১.৫৬ শতাংশ বেশি। বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম এ বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

এবার বাজেটের প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার পরিধি ৩২৯ পৃষ্ঠা করা হয়েছে। অন্য বছর বাজেট ১২-১৫ শতাংশ বাড়ানো হলেও এবার বাড়ছে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র বলছে, আর্থিক সংকট মোকাবিলায় গত কয়েক বছর ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার কৃচ্ছ্রসাধন করে আসছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরির নকশা থাকছে এবারের বাজেটে। নতুন করদাতা যুক্ত করা বা করের জাল বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপ থাকবে। কিন্তু সহজেই কি বেরিয়ে আসা যাবে? বিদেশি ঋণ, সুদ ও ভর্তুকির মতো ব্যয় মেটাতে রাজস্ব খাত চাপে রয়েছে। ব্যয় আরও বৃদ্ধির কারণে চাপ আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকছে। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে ডলার সংকট বিদ্যমান। যে কারণে চলতি অর্থবছরের চেয়ে বেশি মাত্রায় বিদেশি ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ থাকছে বাজেটে, যা অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু বিদেশি ঋণসহ দেশের অভ্যন্তর থেকে নেয়া ঋণও সরকারের দায়দেনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতির সংকট সামাল দিতে এবারের বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট ও করের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষের একটি বড় অংশ নতুন করে আরও চাপে পড়তে পারে।

অর্থবিভাগের তথ্যমতে, উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবারের বাজেটে। 

বাজেটের আকার: জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। নতুন অর্থবছরের বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আয় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। এনবিআর বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আসবে আরও ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের মূল আকার ধরা হয়ে ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। 

ঘাটতি ও বিদেশি ঋণ: অন্যান্য বছরের মতো জিডিপি’র ৫ শতাংশের নিচে রেখেই ঘাটতি (অনুদানসহ) রাখা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৪.৬ শতাংশ। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে অর্থের জোগান দিতে সরকারকে আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। ঘাটতি পূরণে বিদেশি ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর বাইরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা পাওয়া যাবে বলেও ধরা হয়েছে।

ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ: ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ থাকছে। মোট বাজেটের ২০ শতাংশই চলে যাবে সুদ পরিশোধে। টাকার অঙ্কে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে সুদ খাতের ব্যয় বাজেটে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদে ব্যয় হবে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগের নেয়া ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে ২৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা থাকবে নিট বৈদেশিক ঋণ হিসাবে।

জিডিপি: আসছে বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬.৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৭.৫ শতাংশ। পরে অবশ্য তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে।

ব্যয় বাড়ছে: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের প্রায় ৬৪ শতাংশই ব্যয় হবে সরকারের পরিচালন খাতে। এবার ব্যয় বাড়ছে ৮২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। বড় অঙ্কের ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৪ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এটি অর্জন করতে চলতি সংশোধিত রাজস্ব থেকে ৬৬ হাজার কোটি টাকা বেশি আহরণ করতে হবে, যা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে সাধারণ মানুষের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। 

এডিপি: নতুন অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এডিপি’র আকার করা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।  

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না, তাই দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর সরকারকে বেশি ভরসা করতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই ঋণের ভার আরও বাড়বে। বিদেশি ঋণে প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে আরও সতর্ক থাকা উচিত। 
পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ কর আহরণে জোর দেয়া হচ্ছে বেশি। বেশকিছু খাত থেকে কর অব্যাহতি তুলে নেয়ার পাশাপাশি সংকুচিত হতে যাচ্ছে করছাড়ের আওতা। বাড়

বে ভ্যাট ও কর: সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি পোশাক, ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স, পোলট্রি ও ফিশারি খাতেও করছাড় কমানো হতে পারে। নতুন বাজেটে ম্যাঙ্গো বার ও জুস, তেঁতুলের জুস, পেয়ারার জুস, আনারসের জুস ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে নিরাপত্তাসেবা প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এখন এ ধরনের নিরাপত্তাসেবা নিলে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হয়। আগামী বাজেটে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর।

শূন্য শুল্ক থাকছে না: শূন্য শুল্কের অর্ধশতাধিক পণ্যে আগামী অর্থবছর থেকে ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ হতে পারে। বর্তমানে আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই এমন পণ্যের সংখ্যা ৩২৯টি। এ তালিকায় আছে খাদ্যপণ্য, সার, গ্যাস, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, কৃষি উপকরণ ইত্যাদি। শুল্ক আরোপের ফলে এসব পণ্যের জন্য মানুষকে বর্তমানের চেয়ে বাড়তি খরচ করতে হতে পারে।

করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না: আগামী অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না। এখনকার মতো বার্ষিক করমুক্ত সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকাই থাকছে। তবে করহার পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। এখন ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ করহারের সঙ্গে ৩০ শতাংশের আরেকটি স্তর আসছে। বছরে আয় সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার বেশি হলে করদাতাকে বাকি অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

১৩ পণ্যে বাড়ছে ভ্যাট: এলইডি বাল্ব, টিউব লাইট, বিভিন্ন ধরনের জুস, ম্যাঙ্গো বার, রোলিং পেপার, নিরাপত্তা সেবা, নিলাম সেবা, রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনারসহ ১৩টিরও বেশি পণ্য ও পরিষেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় আসতে পারে এই পণ্য। রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ভ্যাটের হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। 
কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, কর অব্যাহতি পর্যায়ক্রমে তুলে নিতে হবে, এটা ঠিক। তবে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ রয়েছে। তাই কর অব্যাহতি তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় নিতে হবে। 
এদিকে অর্থমন্ত্রীর জন্য যে বাজেট বক্তৃতা প্রস্তুত করা হয়েছে তার কিছু অংশ মানবজমিন পেয়েছে। তাতে দেখা গেছে, বৈশ্বিক সংকট, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ডলারের বিপরীতে টানার মান অবনমন, রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি, রিজার্ভের পতন ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ভারসাম্যহীতায় সামগ্রিক অর্থনৈতিক অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে শঙ্কাই দেখছেন অর্থমন্ত্রী। বক্তৃতার একাংশে মুদ্রার অবমূল্যায়নে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের ব্যয়, যা দেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে। এগুলোর জন্য দায়ী করা হয়েছে কোভিড-পরবর্তী ‘রাশিয়া-ইউক্রেন’ যুদ্ধকে। অর্থমন্ত্রীর এই বাজেট বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে সম্মতি দিয়েছেন। 

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, আজ বিকাল ৫টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। আগামী ৩০শে জুলাই বাজেট পাস হতে পারে। এর আগে ১০ই জুন সোমবার চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাস হওয়ার কথা রয়েছে।