এনবিএফআইয়ে খেলাপি ঋণ ১৭৩৯০ কোটি টাকা: আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে খেলাপির ‘ক্ষত’

বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফআই। অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। সেগুলো আদায় হচ্ছে না সময়মতো। যে কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

এনবিএফআইয়ে খেলাপি ঋণ ১৭৩৯০ কোটি টাকা: আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে খেলাপির ‘ক্ষত’

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফআই। অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। সেগুলো আদায় হচ্ছে না সময়মতো। যে কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। ফলে সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।  

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের যোগসাজশে যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিতরণ করা হয়েছে ঋণ। এখন আদায় করতে পারছে না। আবার অনেক ঋণের বিপরীতেও কোনো জামানত নেই। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ভান্ডার বা সিআইবিতে গ্রাহকের তথ্য হালনাগাদ না থাকায় অনেক গ্রাহককে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে অর্থ সংকটে প্রতিনিয়ত দুর্বল হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। কিছু প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এমন অবস্থায় অস্তিত্বহীনতায় পড়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৭০ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা, যা মোট স্থিতির ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যখন ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও কোনো শাস্তি হয় না, উল্টো বিভিন্ন ছাড় পায়-তখন খেলাপি বাড়বেই। কারণ খেলাপিরা দেখছে ঋণ শোধ না করলে বেশি সুবিধা পওয়া যায়। তাই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সুবিধা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ ক্ষত বাড়তেই থাকবে। এছাড়া অনিয়ম দুর্নীতির কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ। কিছু প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিজেরাই অনিয়ম করে অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছে। আমানতকারীদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ফলে গ্রাহকদের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ খাতে নজর কম। যে কারণে এখানে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত যেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করছে বা হয়েছে, এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের এখনই আইন অনুযায়ী দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে এ খাতে পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি জোরদার করা জরুরি।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন প্রান্তিক শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৬৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। খেলাপি ঋণের হার ছিল ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর তিন মাস আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের ঋণ স্থিতির ২০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর তিন মাস আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের ঋণ স্থিতির ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ বিভিন্ন অনিয়ম। গত কয়েক বছরে কিছু প্রতিষ্ঠানে ঋণ জালিয়াতির বিভিন্ন ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের সঙ্গে আর্থিক অপরাধে অভিযুক্ত পি কে হালদারের সম্পৃক্ততা ছিল। অনিয়মের কারণে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানতের মেয়াদপূর্তিতে টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ নিয়ে আমানতকারীরা অভিযোগ করেছেন। 

অন্য কোনো কারণ আছে কি না, জানতে চাইলে সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ আদায়ে বেশ শিথিলতা ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই নির্দেশনা ছিল-কোনো গ্রাহক যদি করোনার প্রভাবে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে তার ঋণ যাতে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০২২ সালে এসে তা আরও শিথিল করা হয়েছে। এর প্রভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে পারে।

বেসরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠানের কারণে এ খাতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ নয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনেক ভালো করছে। সুশাসনের অভাবে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে একটি পিপলস লিজিং। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম এরইমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তার মতে যেসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ঋণ দিয়েছে কিংবা ঋণ বিতরণে কর্মকর্তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেননি, তাদের অবস্থাই খারাপ হয়েছে।

ঝুঁকি বিবেচনায় তিন মাস অন্তর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা যাচাই প্রতিবেদন প্রস্তুত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে কার্যরত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

দেশে প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে আইপিডিসির মধ্য দিয়ে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স দিয়ে থাকে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৪-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর মতো ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও রেগুলেটরি বডি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এছাড়া গত বছর স্ট্র্যাটেজি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট নামে নতুন আরও একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom