ইউক্রেনে ঘাপটি মেরে আছে ‘মৃত্যুফাঁদ’
জীবন হাতে রাশিয়ার পুঁতে রাখা সেই মাইন তুলতে মরিয়া ইউক্রেনের সেনা-কৃষক এবং স্বেচ্ছাসেবক।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক : হাঁটতে গেলেও হিসেব করে পা ফেলতে হয়। মাটির তলায় পরতে পরতে ঘাপটি মেরে আছে ‘মৃত্যুফাঁদ’। একটু অসাবধানতা আর বেখেয়াল হলেই ঘটে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা। নির্ঘাত মৃত্যু নতুবা আজীবন বিকলাঙ্গের বোঝা। এক সময়ের সোনালি সূর্যমুখীর দেশ ইউক্রেন এখন ‘মাইনের কারখানা’। জীবন হাতে রাশিয়ার পুঁতে রাখা সেই মাইন তুলতে মরিয়া ইউক্রেনের সেনা-কৃষক এবং স্বেচ্ছাসেবক।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অলেক্সি রেজনিকভ জানান, ‘আজকের বিশ্বে ইউক্রেনই সবচেয়ে বেশি মাইনের দেশ। শত শত কিলোমিটার মাইনফিল্ড। লাখ লাখ বিস্ফোরক ডিভাইস। রাশিয়ার পুঁতে রাখা এ মাইনগুলো আমাদের সৈন্যদের জন্য গুরুতর বাধা, তবে তা অনতিক্রম্য নয়। আমাদের কাছে দক্ষ স্যাপার (মাইন পরিষ্কারক সৈনিক) ও যন্ত্র রয়েছে। তবে ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বে শত শত কিলোমিটার ফ্রন্টগুলোর জন্য সেগুলো অপর্যাপ্ত।’ দনেৎস্কো অঞ্চলের স্টারমাইয়রস্কের গ্রামে ১৩ জন সদস্যের শক্তিশালী ব্রিগেড মাইন পরিষ্কারের মিশনে যান। যাদের মধ্যে পাঁচজন আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং দুজনের অঙ্গহানি ঘটে।
দিনিপ্রোর মেকনিকভ হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসার সের্হি রাইজেনকো বলেন, ‘প্রতিদিনই হাসপাতালে ৫০-১০০ জন সেনা ভর্তি হন, যাদের অধিকাংশই মাইনের আঘাতে আহত হন। হাসপাতালের ২১,০০০ সৈন্যের মধ্যে ২,০০০ সৈন্যই তাদের প্রাণ হারিয়েছেন। পক্ষাঘাত একবার দেখা দিলে ৯০ শতাংশেরই কোনো না কোনো অঙ্গচ্ছেদ ঘটাতে হয়।’ ইউক্রেনর মাইন পরিষ্কারক দলগুলোকে আরও দক্ষ প্রশিক্ষণ দিতে এক জোট হয়েছে ৫৪টি দেশ। এদের মধ্যে রয়েছে লিথুয়ানিয়া, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানিসহ আরও অনেক দেশ।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘স্যাপারদের প্রশিক্ষণকে প্রসারিত করা এবং ত্বরান্বিত করাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দ্রুত ও পদ্ধতিগত উপায়ে আগানো উচিত। স্যাপারদের কাজ জীবন বাঁচায় এবং আমাদের সৈন্যদের অগ্রগতি নিশ্চিত করে। মাইন উৎখাতের বিষয়টি ‘ট্রেন এবং ইকুইপ’ নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এর দক্ষ বাস্তবায়ন ইউক্রেনের বিজয়কে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
মাইন পরিষ্কারের এনজিও হ্যালো-এর প্রোগাম ম্যানেজার পিট স্মিথ জানান, ১০ হাজার মাইন পরিষ্কারক থাকলেও ইউক্রেনকে মাইনমুক্ত করতে এক দশক সময় লাগবে। হ্যালোর ৯০০ জন সদস্য বর্তমানে ইউক্রেনে কাজ করছেন এবং বছরের শেষ নাগাদ ১২০০ জন প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।’ ভয়ংকর এ বিস্ফোরকগুলোকে আবার পিএফএম-১ বা ‘বাটারফ্লাই’ নামেও ডাকা হয়। এগুলো হালকা ওজনের এবং উচ্চ মাত্রার বিস্ফোরক। এ মাইনগুলো মর্টার, হেলিকপ্টার এবং এরোপ্লেনের মাধ্যমে মাটিতে ও ঘাসের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। সেনাদের বুটের সঙ্গে সামান্য সংস্পর্শেই ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে।
এরপরই রয়েছে পিএমএন সিরিজ। ভয়াবহ এ বিস্ফোরকে পা রাখলেই হচ্ছে অঙ্গহানি। এমওএন-৫০ এবং এমওএন-৯০ নামক মাইনগুলো আশপাশের ৯০ মিটার পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারে। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় পিওএম-২ এবং পিওএম-৩কে।
রকেটের মাধ্যমে এতে থাকা ক্যানিস্টারগুলো প্যারাসুটের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এটি এতটাই ঘাতক যে ১৬ মিটার পর্যন্ত ধ্বংস চালাতে পারে, যা মারাত্মক প্রাণঘাতী। দিনিপ্রোর লেফট্যানেন্ট আলেকজান্ডার কুরবাতোভ বলেছেন, তিনি সোভিয়েত যুগের অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন টিএম-৬২এস এবং ওজেডএম-৭২ খুঁজে পেয়েছেন। রাশিয়ান সৈন্যদের আর্টিলারি ফায়ারে হুসারিভকা দুগ্ধ খামারে প্রায় ২,৫০০ গবাদি পশু মারা যায়। খামারের ডেপুটি ম্যানেজার সেরহিই ভোরোবিওভ বলেন, ‘গরুগুলোর সঙ্গে যা ঘটেছে তার পর তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এখন তাদের কাছাকাছি গেলে তারা ভয় পায়।’ ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে আধুনিক মাইন-ক্লিয়ারিং প্রযুক্তি আসতে শুরু করেছে। একটি ক্রোয়েশিয়ান-নির্মিত রোবট মাইন পরিষ্কারক হিসাবে কাজ করছে।