৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কা

আগের সমীক্ষাগুলো বলছে সাত মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হলে আমাদের দেশে ক্ষয়ক্ষতি তুরস্ক থেকে কয়েকগুণ বেশি হবে।

৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কা
৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কা

প্রথম নিউজ, অনলাইন : বিধ্বস্ত তুরস্ক, বিধ্বস্ত সিরিয়া। স্তব্ধ, শোকাহত গোটা বিশ্ব। প্রকৃতির রুদ্ররূপের সামনে মানুষের অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো আরও একবার। গত সোমবার সকালটা এই দুই দেশের লাখ লাখ মানুষের শুরু হয়েছিল দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতায়। সেদিন ভোরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্মরণকালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় তুরস্ক ও সিরিয়া। ৮৪ বছরের ইতিহাসে এর চেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেনি তুরস্ক। রিখটার স্কেলের যার মাত্রা ছিল ৭.৮। মিনিটখানেক স্থায়ী সেই ভূ-কম্পনে মাটির সঙ্গে মিশে যায় শত শত দালান, বাসাবাড়ি ও বহুতল ভবন। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো আটকা পড়ে আছেন হাজারো মানুষ। উদ্ধার কাজ শেষে মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা অনুমান করে বলা কঠিন।

ভয়াল এই ভূমিকম্প নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। সব মহলে আলোচনা-বড় ধরনের এই ভূমিকম্প অদূর ভবিষ্যতে আরও হতে পারে কিনা? বিশেষ করে তুরস্কের মতো উন্নত রাষ্ট্রে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এতটা তীব্র হলে একই মাত্রার ভূমিকম্পে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কি অবস্থা হবে? এ দেশের সাধারণ মানুষের মনেও এখন একই প্রশ্ন- বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানার সম্ভাবনা কতোটা কিংবা হলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার পরিণতি বা কি হবে? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, বিপদ আসতে পারে যেকোনো সময়। বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। মূলত ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা রাখে ভূ-গর্ভস্থ ফল্ট লাইন। ভূত্বকের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট নামে পরিচিত। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে বলা হয় ফল্ট লাইন। ফল্ট লাইন দিয়ে দুই প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে সংলগ্ন অঞ্চলে ভূকম্পন অনুভূত হয়। বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত কথা হয় বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীর সঙ্গে। দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে এই অধ্যাপক বলেন, তুরস্ক বরাবরই ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। দেশটিতে প্রতি বছরই ছোট থেকে মাঝারি মানের ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

বাংলাদেশের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত করা এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের মূল ভূ-ভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এরকম মোটামুটি ৫টি চ্যুতি (ফল্ট লাইন) আছে। এগুলো ঢাকা শহর থেকে এক থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের ভেতরে অবস্থিত। বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ বলে যেকোনো ফল্ট লাইনে সংঘর্ষ হলে সেটি দেশব্যাপী অনুভূত হয়। স্বল্প থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের দেশে সচরাচর অনুভূত হলেও ৭ কিংবা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয় না। ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যে ৬টি ভূমিকম্প হয়েছিল যার সবক’টির মাত্রা ছিল ৭ এর উপরে। সর্বশেষ আটের বেশি মাত্র ভূমিকম্প হয়েছিল ১৭৬৫ সালে আরাকানে। বড় ধরনের ভূমিকম্পগুলো মূলত ১০০ থেকে দেড়শ বছর পরপর অনুভূত হয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশের যেকোনো সময়ে সাত কিংবা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা শহরেই অন্তত ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি কেমন হতে পারে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মেহেদী আহমেদ বলেন, একশ’ বছর আগে ঢাকা শহরে দালানকোঠা ছিল হাতেগোনা। মানুষের বসবাসও ছিল অনেক কম। আর এখন ঢাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস, বহুতল ভবন আছে ৬ লাখেরও বেশি।

বড় ভূমিকম্পে ঢাকার শহরের ক্ষয়ক্ষতি কতোটা হতে পারে সেটা নিয়ে খুব সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা নেই। তবে আগের সমীক্ষাগুলো বলছে সাত মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হলে আমাদের দেশে ক্ষয়ক্ষতি তুরস্ক থেকে কয়েকগুণ বেশি হবে। এ ধরনের ভূমিকম্পে শুধু ঢাকা শহরেই দুই থেকে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। অন্তত ২৫ শতাংশ বহুতল ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে দেখা দিতে পারে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়। তাই ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সতর্ক হতে হবে এখন থেকে। অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পের ব্যাপারে আগাম ধারণা করা যায় না। যার ফলে এই দুর্যোগে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ নেই। তবে কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ কমাতে পারে ক্ষয়ক্ষতি। মেহেদী আহমেদ বলেন, ঢাকা শহরে দশ কিংবা তার চেয়ে বেশি উঁচু ভবনগুলোতে বিনিয়োগ বেশি থাকে বলে সেগুলো কিছুটা ভূমিকম্প সহনশীল হিসেবে তৈরি করা হয়।

চার-পাঁচতলার ভবনে সেটি করা হয় না। ফলে মাঝারি এই ভবনগুলোতে ঝুঁকি থাকে বেশি। ভূমিকম্প সহনশীলতার ব্যাপারটি বিবেচনায় নিয়ে যাতে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয় সেটি প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। সমীক্ষার মাধ্যমে পুরনো ভবনগুলোর মেরামত ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজ যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য দমকল বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে ও আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম মজুত রাখতে হবে। তবে বড় ধরনের ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি অধিক ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ বিধায় আমাদের যথাযথ নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণের দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: