শর্ত পূরণ না করেই সিইও নিয়োগ দিচ্ছে ফারইস্ট লাইফ
বিমা কোম্পানির সিইও হতে হলে বিমা পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নতুন সিইও হিসেবে নিয়োগ পাওয়া চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দিন বিমা পেশায় যোগ দিয়েছেন ২০১০ সালে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়ে পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক। দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি কোম্পানিটির সিইও পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন হেমায়েত উল্লাহ। তার পরিবর্তে এখন কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ এমন একজনকে সিইও নিয়োগ করতে চেষ্টা চালাচ্ছে, বিমা আইন অনুযায়ী যিনি প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে পারছেন না।
বিমা আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে বিমা কোম্পানির সিইও হতে হলে বিমা পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নতুন সিইও হিসেবে নিয়োগ পাওয়া চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দিন বিমা পেশায় যোগ দিয়েছেন ২০১০ সালে। সে হিসেবে তিনি এখনো সিইও হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেননি। তবে এরই মধ্যে তিনি আরও একটি বিমা কোম্পানির সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণে এবারও সিইও হতে কোনো বাধা নেই বলে দাবি তার।
একসময় ভালো ব্যবসা করা ফারইস্ট লাইফের বিরুদ্ধে সম্প্রতি নজিরবিহীন লুটপাটের তথ্য বেরিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালকও নিয়োগ দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন ড. মুহাম্মদ রহমতউল্লাহকে চেয়ারম্যান করে নতুন পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রাখা হয় মোহাম্মদ সানাউল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সিইও মোহাম্মদ সানাউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বিমা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল গাজী মো. খালিদ হোসেন, স্নেহাশীষ অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া, একাত্তর মিডিয়ার প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোজাম্মেল হক, জি সেভেন সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান, জনতা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিকরুল হক ও নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম চৌধুরীকে।
বিএসইসি থেকে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ১৫ দিনের মাথায় কোম্পানিটির সিইও পদ থেকে হেমায়েত উল্লাহকে বহিষ্কার করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। আইডিআরএ’র এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, কোম্পানি পরিচালনার ক্ষেত্রে হেমায়েত উল্লাহর বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, আর্থিক অনিয়ম, বিমা পলিসি গ্রাহক ও বিমাকারীর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর এবং নিয়ম পরিপন্থি কার্মকাণ্ডের তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে আইডিআরএ’র নজরে এসেছে। বিমা গ্রাহকদের অভিযোগসহ অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
এছাড়া হেমায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে নিজ ভোগদখলে রেখে এবং মিথ্য তথ্য সম্বলিত সম্পদ বিবরণী দাখিলের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে এবং তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ সংক্রান্ত তথ্য কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এরপর ২১ ডিসেম্বর হেমায়েত উল্লাহকে কোনো বিমা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না দিতে নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। সব বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও বরাবর এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ‘হেমায়েত উল্লাহ ২০১১ থেকে ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে উক্ত বিমা কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বিমা আইন, ২০১০ ও বিমা আইনের বিভিন্ন বিধিবিধান অনুযায়ী কোম্পানি পরিচালনার জন্য দায়ী থাকবেন মর্মে তার নিয়োগপত্রে সুস্পষ্টভাবে শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু দায়িত্বকালে কোম্পানিতে ব্যাপক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে মর্মে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। এজন্য তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী।’
এ পরিস্থিতিতেই ফারইস্ট ইসলামী লাইফে নতুন সিইও নিয়োগের পদক্ষেপ নেয় নতুন পর্ষদ। এজন্য বেছে নেওয়া হয় পদ্মা ইসলামী লাইফের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করা চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দিনকে। তবে বিমা আইন অনুযায়ী, তার প্রয়োজনীয় কর্ম অভিজ্ঞতা নেই। ওয়াসিউদ্দিন বিমা পেশায় আসেন ২০১০ সালে, পদ্মা লাইফে যোগ দিয়ে। প্রথমে তিনি কোম্পানিটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) হন। পরে তিনি কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাও হন। অবশ্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় ২০১৫ সালে তার সিইও নিয়োগের আবেদন বাতিল করে আইডিআরএ। কিন্তু দু-বছর পর, ২০১৭ সালে অদৃশ্য কারণে তার সিইও নিয়োগ অনুমোদন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এতে বিমা পেশায় মাত্র সাত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েই সিইও হন ওয়াসিউদ্দিন। অথচ আইন অনুযায়ী, সিইও হতে বিমা পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা লাগে।
বিতর্কিতভাবে নিয়োগ পাওয়ার পর ২০১৯ সালে তার মেয়াদ শেষ হয়। এরপর তার নিয়োগ আর নবায়ন করা হয়নি। ফলে গত দু’বছর তিনি কোনো বিমা কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এখন তাকেই সিইও হিসেবে বেছে নিয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ। ওয়াসিউদ্দিনকে ফারইস্ট লাইফের সিইও হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে কোম্পানিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা ড. মুহাম্মদ রহমতউল্লাহ বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর আমি আপনাকে দিতে পারবো না। কারণ আপনি আমার রেগুলেটরি অথরিটি না। কী পরিস্থিতিতে, কেন, কীভাবে- এর ব্যাখ্যা আমার রেগুলেটরি অথরিটি চাইলে সেখানে আমরা দিতে পারবো এবং যাকেই নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের অনুমোদন লাগে।
অন্যদিকে ওয়াসিউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ থেকে আমাকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে আইডিআরএ থেকে এখনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। আইডিআরএ’র কাছে আবেদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বিমা পেশায় ১৫ বছরের কম অভিজ্ঞতা নিয়ে সিইও হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি এরই মধ্যে পদ্মা লাইফের সিইও ছিলাম। সেখানে আইডিআরএ আমাকে অনুমোদন দিয়েছিল। এটা একটা বিষয়। এটা (সিইও অনুমোদন) বিমা আইন ২০১০ হওয়ার পরেই দিয়েছিল।
এদিকে ২০১৭ সালে ওয়াসিউদ্দিনকে পদ্মা লাইফের সিইও হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন সংক্রান্ত আইডিআরএ’র নথিতে বলা হয়, পদ্মা লাইফের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ওয়াসিউদ্দিন ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ (২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত বাদ দিয়ে) থেকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পদের জন্য একজন উপযুক্ত কর্মকর্তা এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও দুটি পেশাদারি প্রতিষ্ঠানের ফেলো সদস্য। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ ও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
আইডিআরএ’র এই নথিতে উল্লেখ করা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা থাকা অবস্থায় ওয়াসিউদ্দিনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সাফল্যের জন্য প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি কর্মদক্ষতার সাফল্যস্বরূপ মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড থেকে প্রশংসাপত্র, সিএমএ ও আইসিএমএ’র ফলাফলের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন। নথিতে আরও বলা হয়, বিমা খাতে ওয়াসিউদ্দিনের সাত বছরের কর্মঅভিজ্ঞতা থাকলেও বিমা খাতের বাইরে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তার ১৫ বছরের কর্মঅভিজ্ঞতা রয়েছে। তাছাড়া বিমা খাতে দক্ষ, শিক্ষিত ও সুযোগ্য মুখ্য নির্বাহীর খুবই অভাব। এক্ষেত্রে ওয়াসিউদ্দিন অত্যন্ত মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। বিমা খাতকে এগিয়ে নিতে এরকম মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির প্রয়োজন। দেশীয় বিমা খাতের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রশংসাপত্র বিবেচনায় নিয়ে তাকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অনুমোদনের বিষয়ে সভা (আইডিআরএ পর্ষদ) একমত পোষণ করে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে একাধিক বিমা কোম্পানির সিইও বলেন, ওয়াসিউদ্দিনকে ২০১৭ সালে যেভাবে আইডিআরএ সিইও অনুমোদন দিয়েছিল তা সুস্পষ্টভাবে বিমা আইনের লঙ্ঘন। কেন এভাবে সিইও নিয়োগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তা খতিয়ে দেখতে আইডিআরএ’র সাবেক পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। আর আইন লঙ্ঘন করে নিয়োগ পাওয়ায় ওয়াসিউদ্দিনের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করাও অবৈধ হবে।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: