বাংলাদেশে যেভাবে ভারত বিরোধিতাকে প্রতিরোধ করতে হবে

ভারতীয় টেলিগ্রাফের রিপোর্ট

বাংলাদেশে যেভাবে ভারত বিরোধিতাকে প্রতিরোধ করতে হবে

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক : আইসিসি বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের পরাজয় নানাভাবে উদ্যাপন করেছে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি। সেসব উদ্যাপনের ভিডিওগুলো নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ভারতীয়রাও। ওই ইস্যুটি নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছিল, সম্প্রতি বাংলাদেশে শুরু হওয়া ‘ভারত বয়কট’ নিয়ে তা দেখা যাচ্ছে না। যদিও এ নিয়ে সরব বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেল। এমন কিছু প্রমাণ রয়েছে যে, ভারতীয় পণ্য ও চিকিৎসা পরিষেবা বর্জনের এই প্রচারণা চালাচ্ছে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি ইউটিউবার।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশটিতে ভারতবিরোধী মনোভাব রাজনৈতিক অঙ্গনে সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। এমন কি স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস কমে যাওয়ার আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নবগঠিত দেশটির মূল্যবান সম্পদ কেড়ে নেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা মেজর এম এ জলিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন। মওলানা ভাসানীর চীনপন্থি রাজনীতির অনুভূতির উপর ভিত্তি করেই এই দলটি গড়ে উঠেছিল। ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব দুটি প্রধান উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। প্রথমত, বাংলাদেশিদের মধ্যে তাদের মুসলিম পরিচয়ের প্রতি শক্তিশালী আনুগত্য ছিল। ১৯৭১ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামের সঙ্গে এটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।

এই অনুভূতির প্রচারে কাজ করেছে কিছু ইসলামপন্থি দল।  যাই হোক এটি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, মুসলিম ধর্মীয় দলগুলো সর্বদা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেয়েছে। তাদের অধীনে একটি বড় ক্যাডার বেস রয়েছে, যারা সর্বদা ভারতবিরোধী অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। 

দ্বিতীয়ত, ধর্মভিত্তিক এসব দল সর্বদাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৭৫ সালের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের চারপাশে তারা একত্রিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে সহজেই দলটিকে বিএনপি থেকে আলাদা করা যায়। আওয়ামী লীগ বরাবরই বিএনপিকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলে আখ্যায়িত করেছে। প্রধানত জিয়াউর রহমানের সময় তৎকালীন পাকিস্তানপন্থি নেতাদের পুনর্বাসন এবং পরবর্তীকালে খালেদা জিয়ার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের কারণেই এই দাবি করে আওয়ামী লীগ। 

অনুমান করা যায়, এই বিরোধপূর্ণ রাজনীতি ভারত নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যেকার অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বিরোধীরা প্রচার করে চলেছে যে, মূলত দিল্লির ধারাবাহিক সমর্থনের কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে আছে। অনেকের বিশ্বাস, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটি শোষণমূলক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করে এবং তার পণ্যের বাজার হিসেবে ব্যবহার করে।

এই বছরের ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন। এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড, অসুস্থতা এবং তার ছেলে তারেক রহমানের লন্ডনে দীর্ঘ নির্বাসনের কারণে বিরোধী দলের অবস্থা বেশ নড়বড়ে। তারা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের হুমকির ওপরেই বেশি আস্থা রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজিত হয় এবং প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি করা হয়। পশ্চিমাদের হুমকি কাজ না করার জন্যও নয়াদিল্লি থেকে পাওয়া রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থনকে দায়ী করে বিরোধী দলগুলো। প্রচার করা হয় যে, নরেন্দ্র মোদি সরকার ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশের উপর নজরদারি বন্ধে চাপ প্রয়োগ করেছিল।

শেখ হাসিনার সরকার নতি স্বীকার না করায় বিরোধীরা তাদের ক্ষোভকে এখন ভারত বয়কটের দিকে পরিচালিত করেছে। তাদের আশা, এই প্রচারণার কারণে আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তিগুলো অনুপ্রাণিত হবে এবং শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে নয়াদিল্লির উপর চাপ সৃষ্টি করবে। বিরোধিরা মনে করে, ভারতের সমর্থন ছাড়া এই সরকার কাগজের বাঘ। 

যদিও এই বয়কট ভারতীয় পণ্যের জন্য স্বল্পমেয়াদি ধাক্কা তৈরি করতে পারে, তবে এটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে গবাদিপশুর লাভজনক চোরাচালান বন্ধে কোনো প্রভাব ফেলবে না। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের গুরুত্ব সম্পর্কে এই বয়কট কর্মীদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই ভুল ধারনার মূলে আছে যে, অনেক বাংলাদেশির ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান অংশই হলো শুধু পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও ভারত সম্পর্কে তাদের ধারণা অনেক অস্পষ্ট।

বাংলাদেশে এমন একটি অনুভূতি রয়েছে যে, ভারতীয় শ্রমিকরা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো জায়গায় স্থানীয়দের কাজ ছিনিয়ে নিচ্ছে। এটি বাস্তবতা নাকি শুধুই অনুমান তা এখনো প্রমাণিত নয়। তবে দুই দেশের মধ্যে অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বিনিময় রয়েছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ১০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স গেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া ক্রেতাদের জন্য এমন ব্যবস্থাও রয়েছে যেখানে তারা দেশে ফেরার পর ক্রয়কৃত পণ্যের দাম পরিশোধ করতে পারে, তাও আবার বাংলাদেশি মুদ্রায়ই! এমন সুবিধাজনক ব্যবস্থা রাজনীতির কারণে বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বাংলাদেশে ভারত বয়কটের ডাক দেয়ার পর ভারত যখন এ নিয়ে কোনো সাড়া দেবে না, তখন ক্ষুব্ধ হয়ে এর জবাব দেয়, তাহলে তা অন্যায় হবে। এর পরিবর্তে ভারতের উচিত বাংলাদেশের ব্যবসাগুলো যেন ভারতের নিজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে উপকৃত হয় তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশকে যদি ইউপিআই পেমেন্টের অধীনে আনা যায়, তাহলে তা দুই দেশকেই সুবিধা দেবে। উপরন্তু, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও বিনোদন শিল্পকে ভারতের বাজারে আরও বেশি প্রবেশাধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু উদারতা দেখাতে হবে। বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা কখনই পুরোপুরি শেষ হবে না। তবে দেশটি ভারতের বাজারে যত বেশি একীভূত হবে, ভারত বিরোধিতা ততই তার ধার হারাবে।

(টেলিগ্রাফ অনলাইনে প্রকাশিত স্বপন দাশগুপ্ত’র লেখা থেকে অনূদিত)