‘বাংলাদেশে মানবাধিকারের পক্ষের লোক ঝড়ো হাওয়াতেও দমেন না’
মানবজমিনকে ডাচ্ রাষ্ট্রদূত
প্রথম নিউজ, অনলাইন : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর একেবারে শুরুতে যে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল তাদের মধ্যে নেদারল্যান্ডস (১৯৭২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি) অন্যতম। দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে সেই থেকে ইউরোপের উন্নত দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি সুশাসন, মানবাধিকার, দুর্নীতি রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করে আসছে। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত অ্যান ভ্যান লিউয়েন দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এভাবেই বর্ণনা করলেন, ‘আমরা বিগত ৫০ বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পানি, কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং, যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার, পরিবার পরিকল্পনা, সামাজিক উন্নয়ন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার সহ বিভিন্ন বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করছি। আমরা দুটি দেশই ব-দ্বীপ, যা পানি ও কৃষিতে সহযোগিতার বিষয়টি আবশ্যিক করে তোলে।
শিক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে বলা যায়, নেদারল্যান্ডস থেকে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী উন্নত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তৈরি পোশাক, শিল্প খাত, খাদ্য ও কৃষিতে সম্পৃক্ততা সহ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের কাজের প্রভাব দেখে আমি মুগ্ধ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশে ‘টিম ইউরোপ ইনিশিয়েটিভ অন ডিসেন্ট ওয়ার্ক’-এর কো-চেয়ার। রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর বাংলাদেশে শ্রম অধিকারের উন্নয়নে সহযোগিতা ও সমর্থনের জন্য এই প্ল্যাটফরমটি ইইউ দেশগুলোকে নিয়ে এসেছে। গত মাসে, আমাদের দুই দেশ আরও দশ বছরের জন্য ডেল্টা সহযোগিতার বিষয়ে নিজেদের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এই সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে পানি ব্যবস্থাপনা, ওয়াশ (ওয়াটার স্যানিটেশন হাইজিন), কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, নগর উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়াদি এবং জলবায়ু ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হবে।
অতীতে আমরা পানি ব্যবস্থাপনায় দৃঢ়ভাবে সহযোগিতা করেছি। উদাহরণস্বরূপ: সুপরিচিত বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এর কথা বলা যায়। আসছে বছরগুলোতে, আমরা এর অংশ হিসেবে সার্কুলার এগ্রিকালচার এবং এনার্জি এফিসিয়েন্সির ক্ষেত্রে বর্ধিত সহযোগিতা দেখতে পাবো বলে আশা করছি।’ নেদারল্যান্ডস যে সম্প্রতি নারীবাদী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ডাচ্ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এর মানে হলো, ডাচ্ বৈদেশিক নীতির সমস্ত কিছুর প্রধান ফোকাস হয়ে উঠেছে সমঅধিকার এবং সমতা। আমি এতক্ষণ যতগুলো উদাহরণের কথা বললাম, এ সবগুলোর ক্ষেত্রেই আমরা নারী ও সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের অধিকার, প্রতিনিধিত্ব এবং সম্পদের উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করি। আমি মনে করি আমরা উন্নয়ন ও প্রকল্পের উপর কম জোর দিয়ে, অর্থনৈতিক সহযোগিতার উপর বেশি জোর দিয়ে ধীরে ধীরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরও পরিবর্তন দেখতে পাবো।’
২০১৭ সাল থেকে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশে এই শরণার্থীদের জন্য মানবিক প্রতিক্রিয়াকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতারও প্রচার করছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতির সাম্প্রতিক কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দেখছেন কিনা জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত অ্যান ভ্যান লিউয়েন কিছুটা হতাশার সুরেই জানালেন, তার দেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় সম্প্রদায়কে সহায়তা করা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা সংকট সহ বিশ্বের অন্যান্য সংকটগুলোর প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘এর মানে হলো, শরণার্থীদের জন্য টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা এখন আরও বেশি প্রয়োজন, কারণ মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের সেখানে ফিরে যাওয়া অসম্ভব করে তুলেছে। তাই, নেদারল্যান্ডস শরণার্থীদের কাজকর্মে ব্যস্ত রাখতে এবং কিছুটা আশা প্রদানের জন্য কক্সবাজারে দক্ষতা উন্নয়ন এবং জীবিকার কার্যক্রমকে সমর্থন করে, কারণ এটি গুরুত্বপূর্ণ। শরণার্থীরা মিয়ানমারে ফিরে গেলেও তারা এই দক্ষতাগুলো কাজে লাগাতে পারবে। একজন শরণার্থী সম্প্রতি যেমনটি বলেছেন: আমরা ফিরে গেলে কিছুই নিয়ে যেতে পারবো না, আমরা যা নিতে পারি তা হলো শিক্ষা এবং দক্ষতা। আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার প্রক্রিয়াগুলোর ক্ষেত্রে পদ্ধতিগুলোতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, তাই আমি শিগগিরই কোনো ফলাফল আশা করি না। যদিও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য রায় রোহিঙ্গাদের দুর্দশার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি হবে, কিন্তু এতে সম্ভবত মিয়ানমারের বাস্তব অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে না।’
বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা দেশগুলোর জোট মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের (এমএফসি) ডিপ্লোম্যাটিক নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভ সম্প্রতি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারের পরিসরে নেদারল্যান্ডসের সম্পৃক্ততার বিষয়ে বলতে গিয়ে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে দেশটির রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘২০২২ এবং ২০২৩ সালের জন্য নেদারল্যান্ডস এবং কানাডা মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের কো-চেয়ার। এমএফসি ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখন ছয়টি মহাদেশের ৫০টির বেশি দেশ এর সঙ্গে রয়েছে। এমএফসি-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর (কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রচারের জন্য ২০২৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশেও আমরা এটি চালু করেছি।’ বিশ্বের যেকোনো স্থানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বচ্ছ সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি মন্তব্য করে ডাচ্ রাষ্ট্রদূত বলেন, স্বচ্ছতার কথা যদি বলি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং সুশাসন প্রচারে আমাদের অঙ্গীকারেরই ইঙ্গিত দেয়। অধিকন্তু, তথ্যের অধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং সমাবেশ, গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তি, যৌন বৈচিত্র্য সম্প্রদায়কে সমর্থন এবং নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলোতে আমরা সুশীল সমাজকে শক্তিশালী করার জন্য নিযুক্ত আছি।’
রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম নেদারল্যান্ডস এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎকে তিনি কীভাবে দেখছেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঐতিহ্যগত উন্নয়ন সহযোগিতার দিক থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং জ্ঞান বিনিময়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সমান অংশীদারের সম্পর্কের দিকে সরে যাবে। তাই, আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডসের সম্পৃক্ততা হবেÑ উন্নয়ন সহযোগিতাকে ধীরে ধীরে বন্ধ করে রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নিবিড় করার উপর জোর দেয়া। নেদারল্যান্ডস বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং জ্ঞান বিনিময়, বিশেষ করে পানি ও কৃষিক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে থাকবে। এ ছাড়াও আমরা প্রাসঙ্গিক কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইনের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নারীদের জন্য ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে আমাদের সম্পৃক্ততা জোরদার করবো। আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই সম্পর্কিত আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ চালিয়ে যাবো এবং এই সমস্ত কার্যক্রমে সুশীল সমাজের মানুষদের সমর্থন করবো।’
বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগদানের আগে এই ডাচ্ কূটনীতিক সুরিনাম ও গায়ানা, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, এঙ্গোলা সহ নানান দেশে কাজ করেছেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘প্রতিটি দেশই অনন্য, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতা এবং দৈনন্দিন জীবনে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যে সুখ অটল থাকে তা আমাকে স্পর্শ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বার্ষিক বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুগছেন এমন লোকদের সংগ্রাম দেখে আমি বিস্মিত। যারা মানবাধিকারের জন্য দাঁড়িয়েছেন তাদের দেখে আমি অভিভূত, তারা ঝড়ো হাওয়াতেও দমে যান না। এই সংগ্রাম সব জায়গায়, সব মানুষের মধ্যে বিরাজমান। উপরন্তু, এটা আমাকে অবাক করে যে বাংলাদেশিরা কী ধরনের পরিশ্রমী এবং উদ্যোক্তা। এই ‘ক্যান ডু স্পিরিট’-এর জন্যই দেশটি গত পঞ্চাশ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিস্ময়কর যাত্রা করেছে। বাংলাদেশিরা অতিথিপরায়ণ এবং আমি সবসময়ই তাদের চমৎকার কবিতা এবং সাহিত্যে মুগ্ধ হই। পাশাপাশি আমি সত্যিকারেই বাংলাদেশি খাবার উপভোগ করতে শিখেছি। আমি প্রাণবন্ত ‘আর্ট সিন’ এবং সুন্দর সব পাখিদেরও অনুরাগী। বাংলাদেশের মনোরম গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে আমার ভালো লাগে।’
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: