বিদেশী পর্যবেক্ষক আনা: কে এই আবেদ আলী!
আরেক পর্যবেক্ষণ সংস্থা সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেলও তিনি। প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে সার্কের লোগো ব্যবহার করায় তা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশে চিঠি দিয়েছিল সার্ক সচিবালয়।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: মোহাম্মদ আবেদ আলী। আলোচিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের চেয়ারম্যান। আরেক পর্যবেক্ষণ সংস্থা সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেলও তিনি। প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে সার্কের লোগো ব্যবহার করায় তা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশে চিঠি দিয়েছিল সার্ক সচিবালয়। আবেদ আলী নামের আগে জুড়ে দিয়েছেন অধ্যাপক পদ। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতার কথা বলছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি জাল জালিয়াতির কারণে কয়েক বছর আগেই বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কথিত এই অধ্যাপক এখন আর কোথাও শিক্ষকতা করেন না। পেশা হিসেবে দুই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছেন। সম্প্রতি কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে ঢাকায় এনে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। বলা হচ্ছে সফরে আসা কথিত পর্যবেক্ষকদের কেউই স্বীকৃত কোনো পর্যবেক্ষক নন।
আবেদ আলী কোনো পক্ষের হয়ে তাদের নিয়ে এসেছেন। নানাপক্ষের সঙ্গে বৈঠক, আলোচনার পর এই বিদেশি অতিথিরা যে বক্তব্য দিচ্ছেন তা দেখে তাদের ‘ভাড়াটে’ বলেও আখ্যা দিচ্ছেন কেউ কেউ। এর আগের জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ৩ মাস আগে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নিয়েছিল ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম। ওই নির্বাচনের সময় এভাবে কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে এনে সমালোচিত হয়েছিলেন আবেদ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবেদ আলীর জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার আলীনগর গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম শহরের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। নানা অনিয়মের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ বছর শিক্ষকতা করেছেন বলে জানিয়েছেন আবেদ আলী। তার ভাষ্য ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ওই বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কিনা এ বিষয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিশ^বিদ্যালয়টির কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
সার্টিফিকেট বিক্রি করার অভিযোগে বন্ধ হওয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডেও আছেন বলে আবেদ আলী জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা পরিচালনার পাশাপাশি নিশাত শিপিং সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেড ও এমএস বিসমিল্লাহ অয়েল সাপ্লায়ার নামে দুটি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে আছেন তিনি।
এদিকে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সংস্থাটির উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরকার দলীয় একজন এমপি। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটিতে সহ-সভাপতি হিসেবে রয়েছেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা।
সংস্থাটির সভাপতি হলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া। এ ছাড়া তিনি এবি ব্যাংক লিমিটেডের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ‘গভর্নিং বডি’র গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া সংস্থাটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন, লায়ন এম. জাফরুল্লাহ এমজেএফ।
ওদিকে ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ফোরামের উপদেষ্টা সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী। তিনি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। ওই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া ফোরামের ৮ জন পরিচালকের মধ্যে রয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ। তিনি কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃৃত্বাধীন কমিশনে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। তাদের অধীনে ২০১৪ সালে একতরফা জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ফোরামের পরিচালক হিসেবে আছেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাবিবুর রহমান, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য আবুল কালাম আজাদ, বুয়েটের সহ-উপাচার্য আবদুল জব্বার খান, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাহফুজুল ইসলাম, ব্যবসায়ী ইকবাল বাহার, ব্যাংক কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া ও তানভিরুল ইসলাম।
সংস্থায় একাধিক রাজনীতিবিদ থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবেদ আলী বলেন, কয়েকটি দলের রাজনীতিবিদ থাকলেও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এর কোনো প্রভাব পড়ে না। শতভাগ নিউট্রলের কথা বলছি না। ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ৩ মাস আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ইসি’র পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন পায় সংস্থাটি। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে সংস্থাটি থেকে জানানো হয়েছিল।
এদিকে ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম ৪ জন বিদেশি নাগরিককে ঢাকায় নিয়ে এসে তাদেরকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। যদিও তাদের কেউ আন্তর্জাতিক কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থার প্রতিনিধি নন। ৪ বিদেশি নাগরিকের দুজন সাংবাদিক আর দুজন সমাজকর্মী। এর আগে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় কয়েকজন বিদেশিকে এনে তাদের আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ঘটনায় বিতর্কিত হয়েছিল সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন।
ইসি সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নিবন্ধন চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে ২০৬টি বেসরকারি সংস্থা। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেছে ৯৪টি। এর মধ্যে আবেদ আলীর দুই প্রতিষ্ঠান সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন ও ইলেকশন মনিটরিং ফোরামও রয়েছে।