ফরিদপুরে থামছে না ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যু, স্যালাইনের জন্য হাহাকার

রোগীকে মেঝেতে-বারান্দায়, রাস্তায় বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে চরম সংকট দেখা দিয়েছে স্যালাইনের। বেড়েছে রক্তের চাহিদা।

ফরিদপুরে থামছে না ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যু, স্যালাইনের জন্য হাহাকার

প্রথম নিউজ, ফরিদপুর: ফরিদপুরে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল। হাসপাতালগুলোতে চলছে শয্যা সংকট। অনেক রোগীকে মেঝেতে-বারান্দায়, রাস্তায় বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে চরম সংকট দেখা দিয়েছে স্যালাইনের। বেড়েছে রক্তের চাহিদা।

জানা গেছে, জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালের পাশাপাশি শিরায় দেওয়া স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে ওষুধের দোকানগুলোতেও। বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে রোগীর স্বজনদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। অধিকাংশ ফার্মেসিতে মিলছে না কোনো স্যালাইন। মাঝে মধ্যে পাওয়া গেলেও তা কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। আবার স্যালাইন না পেয়ে অনেকেই ফিরছেন খালি হাতে।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বেশি স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় সাধারণত দশমিক ৯ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড স্যালাইন রোগীর শরীরে পুশ করতে হয়। এটাকে ‘নরমাল স্যালাইন’ বলা হয়।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৬৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৮০২ জন। জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আট হাজার ১৬৩ জন। এর মধ্যে সাত হাজার ৩৩১ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩০ জন রোগী।

ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডায়াবেটিস হাসপাতাল, মুজিব সড়কসহ বিভিন্ন উপজেলার হাসপাতালের সামনে অন্তত ২০টি ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে স্যালাইন পাওয়া যায়নি। দোকানিরা জানিয়েছেন, প্রায় মাস খানেক ধরে ওই স্যালাইনের প্রচুর চাহিদা দেখা দিয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় একেবারেই সরবরাহ নেই। তাই রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।

বোয়ালমারী উপজেলা সদরে অবস্থিত ভাবনা ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে আসা মো. সুমন ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, জেলা শহরের হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর ব্যাপক চাপ। হাসপাতালে শয্যা সংকট। স্যালাইন সংকট। বাজারের প্রায় দশটি দোকান খোঁজ করেও এক ব্যাগ স্যালাইন পাইনি। যে দোকানেই যাই সেখানে স্যালাইন নেই।

ফরিদপুর মেডিকেল হাসপাতাল এলাকায় ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে আসা কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমার চাচা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালে স্যালাইন নেই। বাইরে থেকেও কিনতে পারছি না। অন্তত ১৫টি ফার্মেসি ঘুরে এক ব্যাগ স্যালাইন পেয়েছি। এরপরও যদি স্যালাইন দরকার হয় তাহলে কোথায় পাবো ভাবছি।

শহরের পাংশা ড্রাগ অ্যান্ড সার্জিক্যালে স্যালাইন কিনতে আসা এক রোগীর স্বজন আজিজুল শেখ জাগো নিউজকে বলেন, নগরকান্দা থেকে এসেছি। আমার এক রোগী মেডিকেলে ভর্তি। দুইদিন ধরে কমপক্ষে ১৫টি দোকান ঘুরেও এক ব্যাগ স্যালাইন জোগাড় করতে পারিনি। টাকা হলেও স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না।

এ ব্যপারে ফরিদপুরের কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি মাজহারুল আলম চঞ্চল বলেন, শুধু ফরিদপুর নয়, সারাদেশেই ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। ফরিদপুরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় মাস খানেক ধরে স্যালাইনের সংকট চরম আকার ধারণ করছে। কোম্পানিগুলো স্যালাইন দিতে পারছে না। এখানে কোনো সিন্ডিকেট নেই। কোনো ওষুধ ব্যবসায়ী নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নিচ্ছেন না।

ফরিদপুরের মুক্ত সমাজ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সভাপতি ও ফরিদপুর ব্লাড লিংক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য পারভেজ হাসান রাজিব বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্যালাইন সংকটের পাশাপাশি রক্তের চাহিদা প্রায় ৪ থেকে ৫ গুন হারে বেড়েছে। এ ব্যপারে কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের সদস্য ও গরীবের বন্ধু হিসেবে পরিচিত সুমন রাফি বলেন, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভরা। ডেঙ্গু রোগীর জন্য স্যালাইন সংকট ও রক্তের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগী ও স্বজনদের মধ্যে হাহাকার চলছে।

এ ব্যপারে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী পাংশা ড্রাগ অ্যান্ড সার্জিক্যালের মালিক আকবর বিশ্বাস রাজু বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুবই খারাপ। প্রায় এক মাস ধরে স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য ১০০০ এম এল স্যালাইনের দাম মাত্র ৮৭ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে টাকা দিয়েও মিলছে না স্যালাইন। কোম্পানির লোকজন চাহিদা মতো ডেঙ্গু রোগীর জন্য স্যালাইন দিতে পারছে না।

এ বিষয়ে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সোহেল শেখ  বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জন্য ডিএনএস স্যালাইনের দাম নিয়ন্ত্রণে ফার্মেসি নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। গত দুই দিন আগে দাম বেশি নেওয়ায় কয়েক ফার্মেসি মালিককে জরিমানা করা হয়েছে। ফার্মেসি মালিকরা স্যালাইনের সরবরাহ ও সংকটের কথা জানিয়েছেন। তবে অভিযান পরিচালনা করা হলেও স্যালাইনের দাম বেশি নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. কবির সরদার বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট রয়েছে। হাসপাতালে যে পরিমাণ স্যালাইন বরাদ্দ ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে বরাদ্দ চেয়ে চাহিদা পত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে রোগীদের জন্য দেওয়া সম্ভব হবে। এছাড়াও ফার্মেসিগুলোতেও চাহিদা মতো স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না। স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ওপসো স্যালাইন কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার অজয় চন্দ্র রায় বলেন, আসলে এটা সংকট না। ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে চাপের সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে সাপ্লাই বেড়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে রোগীর চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সাপ্লাই দেওয়ার।

ফরিদপুর জেলা ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেন্টটেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের (ফারিয়া) সভাপতি মৃধা তারিকুল ইসলাম তারেক বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে স্যালাইনের ব্যাপক সংকট ছিল। টাকা হলেও স্যালাইন পাওয়া যেতো না। খুবই খারাপ পরিস্থিতি ছিল। তবে দুই একদিন ধরে কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। তারপরও সংকট রয়েছে। মানুষের চাহিদা মতো স্যালাইন মিলছে না।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনামুল হক বলেন, হঠাৎ করে ডেঙ্গুর রোগীর চাপ বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে। তবে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে স্যালাইন থাকলেও তা শেষের দিকে। এমন পরিস্থিতি থাকলে শীঘ্রই বেশি বরাদ্দ না পাওয়া গেলে সংকট তৈরি হবে। হাসপাতালের বাইরে ফার্মেসিতে স্যালাইন সংকট আছে কিনা জানা নেই।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পুরোপুরি স্যালাইনের সংকট নেই। একটু সমস্যা হয়েছিল। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অতিরিক্ত স্যালাইন দিয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দের জন্য চাহিদা পত্র পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু হলেই যে সব রোগীর স্যালাইন প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। রোগী ও স্বজনরা মনে করেন ডেঙ্গু হলেই স্যালাইন লাগবে। যে কারণে তারা স্যালাইনের জন্য ছুটাছুটি করেন। আবার রোগীর চাপ ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণেও স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে।